Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মৃত্যু মাথায় নিয়ে জাহাজ ভাঙেন তারা


১ মে ২০১৯ ১২:৩৪

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ১৯৬০ সালে বঙ্গোপসাগর উপকূলের সীতাকুণ্ডে এমডি আলপাইন নামে বিকল হওয়া একটি জাহাজ কাটার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ‘জাহাজ ভাঙা’ শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। অর্ধশত বছর পেরিয়ে সীতাকুণ্ড উপকূলে এখন বছরে জাহাজ ভাঙা হয় অন্তত ১০০টি। দেশে ইস্পাতের চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশের যোগান আসে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে। দিনে দিনে বেড়েছে শিল্পের পরিধি। ব্যবসার আকার ১০ হাজার কোটি টাকারও উপরে।

সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ডগুলোতে এখন কাজ করে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক। অর্ধশত বছর পার করা এই শিল্পের পরিধি বাড়লেও বাড়েনি শ্রমিকদের জীবনমান। জাহাজ কাটতে গিয়ে এখনও বেঘোরে প্রাণ যায় শ্রমিকদের। দেশের দূর-দূরান্তের বিভিন্ন জেলা থেকে কাজের খোঁজে শিপইয়ার্ডে এসে লাশ হয়ে ফিরতে হয় হতভাগ্য শ্রমিকদের অনেককে। জাহাজ কেটে যারা বাড়াচ্ছে মালিকের পুঁজি আর সরকারের কোষাগার, তাদের জীবন ভরা হাজারো দু:খগাঁথায়।

বিজ্ঞাপন

মে দিবসকে সামনে রেখে কথা হয় শিপ ব্রেকার্স ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের সভাপতি তপন দত্তের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশ উন্নত হচ্ছে, শিপইয়ার্ডগুলোতে ব্যবসা বাড়ছে। কিন্তু শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি বলতে যেটা বোঝায়, সেটার বরং দিন দিন অবনতি হচ্ছে। তবে একটা জায়গায় কিছুটা উন্নতি এসেছে। আগে শিপইয়ার্ডে শ্রমিক মারা গেলে লাশ গায়েব করে ফেলা হত। এখন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর তৎপরতার কারণে সেটা পারে না। লাশ ফেরত দিতে হয়।’

শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা। সংস্থাটির হিসেবমতে, জাহাজভাঙ্গা কারখানায় গত পাঁচবছরে মারা গেছেন ৮০ জন শ্রমিক। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ২০ জন, ২০১৭ সালে ১৫ জন, ২০১৬ সালে ১৭ জন, ২০১৫ সালে ১৬ জন এবং ২০১৪ সালে ৯ জন শ্রমিক কারখানায় কাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছেন তিনজন।

বিজ্ঞাপন

তবে, শিপ ব্রেকার্স ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের হিসেবমতে, গত পাঁচবছরে মারা গেছেন ৮২ জন। এর মধ্যে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে মারা গেছেন ৫ জন।

তপন দত্ত সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাহাজ যত বেশি আসে, তত বেশি দুর্ঘটনা হয়। তত বেশি শ্রমিক মরে। এদের জীবনের যেন কোনো গ্যারান্টি নেই। সুরক্ষা না থাকায় এভাবে প্রাণহানি ঘটছে।’

ইপসা’র কর্মসূচি সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী শাহীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৮ সালে মারা গেছে ২০ জন। ইয়ার্ড কার্যকর আছে ৬০টার মতো। এই হিসেব দেখলে বোঝা যায় শ্রমিকরা নিরাপত্তাহীন কর্মপরিবেশে কাজ করে। ব্যবসা যত বাড়ছে, শ্রমিকদের নিরাপত্তার ঝুঁকিও তত বাড়ছে। প্রাণহানির পাশাপাশি পরিবেশ দূষণও হচ্ছে।’

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মাদাম বিবির হাট, কুমিরা, ভাটিয়ারি, সোনাইছড়ি, জাহানাবাদ, কদমরসূল, বাঁশবাড়িয়া উপকূলজুড়ে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোর অবস্থান। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সীতাকুণ্ডে ১৮৬টি জাহাজ ভাঙা কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্র আছে। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০টি ইয়ার্ড বতর্মানে কার্যকর আছে।

চলতি বছর চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডের শীতলপুরের চৌধুরীঘাট এলাকায় সাগরিকা শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজে তেলের ট্যাংকার কাটার সময় আগুনে পুড়ে দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এই দুর্ঘটনার পর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন দপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিষ্ফোরক অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা ইয়ার্ডটি পরিদর্শন করেন।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নিহত শ্রমিকদের শরীরে কোনো সুরক্ষা পোশাক ছিল না। এছাড়া, ইঞ্জিন কক্ষ কাটার সময় তেল, গ্যাসজাতীয় দাহ্য পদার্থ নিয়ে যে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় সেটাও করা হয়নি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সুরক্ষা এবং সাবধানতা না থাকায় শিপইয়ার্ডগুলোতে প্রাণ হারাচ্ছে শ্রমিকরা।

তবে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) সভাপতি আবু তাহের দাবি করেছেন, শিপইয়ার্ডে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ায় আগের চেয়ে প্রাণহানি কমেছে।

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘শ্রমিকদের বিষয়ে আমরা খুব সতর্ক থাকি। এখন তো শিপইয়ার্ডে দুর্ঘটনা কমে এসেছে। এরপরও কোন দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু হলে আমরা ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত দিচ্ছি। আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করছি।’

শিপ ব্রেকার্স ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের সভাপতি তপন দত্ত সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারি নিয়ম আছে, দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের স্বজনদের তাৎক্ষণিকভাবে দুই লাখ টাকা দিতে হয়। পরিবারকে পরবর্তীতে আরও চার লাখ টাকাসহ মোট ছয় লাখ টাকা দিতে হয়। প্রথম পর্যায়ে দুই লাখ টাকা শ্রম অধিদপ্তর বা আদালতের মাধ্যমে দিতে হয় বলে সেটি এখন পাওয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশ শ্রমিকের পরিবারই পরবর্তীতে আর ৪ লাখ টাকা পান না। মালিকরা বিভিন্ন গড়িমসি করে সেই টাকা আর দেয় না। কারও বাড়ি নওগাঁ, কারও বাড়ি পঞ্চগড়। তারা ক’দিন আর গাড়িভাড়া খরচ করে চট্টগ্রামে এসে টাকার জন্য ধর্ণা দেবে?’

শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি শিপইয়ার্ডগুলো পরিবেশকেও অনিরাপদ করে তুলেছে বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর। স্ক্র্যাপ’ জাহাজে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য, অ্যাসবেস্টস, গ্লাসহোল, লুব্রিকেন্ট ওয়েলসহ নানা ধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর বর্জ্য থাকে। এসব বর্জ্য পরিবেশসম্মত উপায়ে অপসারণের বিধান থাকলেও শিপইয়ার্ডগুলো সেই বিধান মানছে না বলে অভিযোগ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারি পরিচালক (কারিগরি) মুক্তাদির হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৮৬টি কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্র আছে। এর মধ্যে ৬টি গ্রিণ শিপইয়ার্ডের মর্যাদা পেয়েছে। সেগুলোর বর্জ্য অপসারণ প্রক্রিয়া পরিবেশসম্মত। বাকিগুলোর মধ্যে যেগুলো কার্যকর আছে, সেগুলোরও পরিবেশসম্মত বর্জ্য অপসারণ পদ্ধতি আছে। তবে সেটা তারা অকার্যকর করে রাখে। আমরা নিয়মিত সেখানে পরিদর্শন করি। গত দুইমাসে আমরা কমপক্ষে ১২টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছি।’

বিএসবিএ সভাপতি আবু তাহের সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা আগের চেয়ে বেড়েছে। শিপইয়ার্ড কমেছে, কিন্তু জাহাজ আসার পরিমাণ বেড়েছে। বছরে এখন আমরা ১২০০ কোটি টাকার ওপরে সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছি। এই শিল্প এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি যেগুলো আছে, সেগুলো আমরা সমাধান করে ফেলব।’

সারাবাংলা/আরডি/জেএএম

জাহাজ ভাঙা

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর