ইসলামি দলগুলোর ‘সন্তুষ্টি’র রাজনীতি
৮ মে ২০১৯ ২৩:৩৮
ঢাকা: আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা মানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান থাকে রাজপথে। জাতীয় শিক্ষানীতি, নারীনীতি, ধর্মানুভূতিতে আঘাত, ভাস্কর্য স্থাপন, সর্বোপরি নাস্তিক-আস্তিক ইস্যুতে রাজপথ গরম করে রাখাই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো প্রধানতম কাজ হয়ে ওঠে।
কিন্তু এই সরল সমীকরণটা এখন আর নেই। বদলে গেছে ইসলামি দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ‘অযৌক্তিক’ বাড়াবাড়ি, কারণে-অকারণে ‘রণহুংকার’, ‘ইসলামবিরোধী’ আখ্যাসহ নন-ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে অনাহুত চাপ তৈরি করাই ছিল ইসলামি দলগুলোর রুটিন ওয়ার্ক। সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ জিইয়ে রাখাই ছিল ইসলামি দলগুলোর প্রধান এজেন্ডা।
তবে এসব অসন্তোষ দূরে ঠেলে এখন অনেকটা ‘সন্তুষ্টি’র রাজনীতি করছে ইসলামি দলগুলো। সরকারও ইসলামি দলগুলোর ব্যাপারে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। ইসলামি দলগুলোর দাবি-দাওয়া পূরণসহ রাষ্ট্রের সকল কর্মকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর ব্যাপারে যত্নশীল রয়েছে সরকার।
কিন্তু বছর পাঁচেক আগেও দৃশ্যপট এমন ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ইসলামি দলগুলোর সম্পর্ক ছিল দা-কুমড়ার। বিএনপি-জামায়াত জোটের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে ২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল ও ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে ‘হেফাজতকাণ্ড’ এর অন্যতম উদাহরণ। এই হেফাজতকাণ্ডের আগেও নানা ইস্যুতে রাজপথ দখলের অসংখ্য মহড়া প্রদর্শন করেছে ইসলামি দলগুলো।
তবে সময়ের পরিক্রমায় সরকারবিরোধী গড়পরতা অবস্থান থেকে সরে এসেছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। কতগুলো কমন ইস্যুতে সরকারের পাশেই থাকছে তারা। সরকারকে অনাহুত খোঁচাখুচি করা এবং কারণে-অকারণে সরকারের বিরেুদ্ধে অসন্তোষ ছড়ানোর প্রবণতা থেকে সরে এসেছে এসব দল। শুধু তাই নয়, সরকারের বেশিরভাগ কর্মকাণ্ডকে অকুণ্ঠ সমর্থনও দিয়ে যাচ্ছে তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারের ব্যাপারে ইসলামি দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তনের মূলে রয়েছে ‘আল হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’ আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর অধীন কওমি মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের (তাকমীল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির (ইসলামিক স্ট্যাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান।
এছাড়া মাদরাসায় পড়ুয়াদের প্রতি সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, আলেম-উলামাদের সঙ্গে সরকারের প্রধান ব্যক্তি থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সৌজন্যমূলক আচরণ এবং তাদের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণের কারণে ইসলামি দলগুলো সরকারের প্রতি মোটামুটি সন্তুষ্ট রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু ধর্মীয় বিষয় নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি মসজিদ-মাদরাসায় সরকারি অনুদান, অযাথা হয়রানি থেকে আলেম-উলামাকে রেহাই দেওয়া, ক্ষেত্র বিশেষ কওমি মাদরাসাগুলোতে অর্থ ও জায়গা-জমি বরাদ্দ দেওয়ায় সরকারের প্রতি মোটামুটি সন্তুষ্টই রয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো।
এই সন্তুষ্টি থেকেই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সবগুলো ইসলামি দল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। কেউ জোটের শরিক দল হিসেবে, কেউ বা এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়। ভোটের অভিজ্ঞতা ভালো না হলেও সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে কোনো কর্মসূচি দেয়নি ইসলামি দলগুলো।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ইসলামি দল বাংলাদেশ মুসলিম লীগ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬৮ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং সবগুলো আসনেই পরাজিত হয়। তারপরও সরকারের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। মাঠে কোনো কর্মসূচিও দেয়নি তারা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের নানা ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। সেগুলো নিয়ে কথা বলার জন্য, আন্দোলন সংগ্রাম করার জন্য বৃহত্তর জোট এবং বড় বড় রাজনৈতিক দলও আছে। আমরা আমাদের কাজ করছি।’
‘তাছাড়া এ সরকারের সাফল্যও তো কম নয়। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরি করছে। এটি শেষ করতে পারলে সরকারের জন্য বড় সাফল্য হয়ে থাকবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য রাজনীতি চর্চার জায়াগটা সীমিত করে ফেলেছে এ সরকার। এ বিষয়টির সমালোচনা করা যেতে পারে’,— বলেন কাজী আবুল খায়ের।
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি হিসেবে এই সরকারকে আমরা ভালো চোখেই দেখি। তাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও প্রশংসার দাবিদার। মাদরাসা, বিশেষ করে কওমি মাদারাসার শিক্ষা ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গোটা আলেম সমাজকে সম্মানিত করেছে সরকার। সে কারণে এ সরকারের প্রতি আমরা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করি।’
‘তবে এবারের নির্বাচনটা তারা ভালো করতে পারেনি। এই বিষয়টি আমাদের পীড়া দেয়’,— বলেন সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী।
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব এম. এ. মতিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে ইতিবাচক হিসেবে দেখি। তবে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিন্দনীয়। বিশেষ করে ৩০ তারিখের ভোট ২৯ তারিখ রাতে করে তারা নিন্দনীয় কাজ করেছে। এছাড়া সরকারের বাকি কর্মকাণ্ড প্রশংসার দাবি রাখে।’
এছাড়া বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া ইসলামি দলগুলোর শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যেই সরকার ও সরকারপ্রধানের ভূয়সী প্রশংসা অব্যাহত রেখেছেন। সম্প্রতি বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে আয়োজিত এক সমাবেশে ইসলামী ঐক্য জোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, কেন্দ্রীয় নেতা মুফতি হাসানাত আমীনি সরাসরি বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে এক সময় আমরা আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করেছি। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স ডিগ্রির মর্যাদা দিয়ে আমাদের সম্মানিত করেছেন। সুতরাং তার সম্মান রক্ষায় আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
সারাবাংলা/এজেড/এটি