‘একবার বের হ, রেইপ করে ফেলব’—চিকিৎসককে ছাত্রলীগ নেতা
১০ মে ২০১৯ ২০:৫৯
ঢাকা: সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসককে ‘ধর্ষণের’ হুমকি দিয়েছেন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা। কর্তব্যরত চিকিৎসককে ছাত্রলীগ নেতা বলেছেন, একবার বাইরে বের হ, রেইপ করে ফেলব। আমার পা ধরে তোকে মাফ চাইতে হবে।’ এ সময় তিনি কোমর থেকে ছুরি বের করে ওই নারী চিকিৎসককে হত্যার হুমকি দেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
তবে ‘মাথাগরম’ হয়ে যাওয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন হুমকিদাতা ওই ছাত্রলীগ নেতা। তিনি জানান, ওই চিকিৎসক দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে নিয়ে কথা বলায় এ ‘তর্ক-বিতর্ক’ হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ( ৯ মে) দুপুরে এই ঘটনা ঘটে। এর প্রতিবাদে হাসপাতালের বাইরে এসে চিকিৎসকরা কর্মবিরতিও পালন করেন। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে তারা রাত সাড়ে ১০টার দিকে তারা কাজে যোগ দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হুমকিদাতা ওই ছাত্রলীগ নেতার নাম সারোয়ার হোসেন চৌধুরী। তিনি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। সারোয়ার সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও কাউন্সিলর আজাদুর রহমানের অনুসারী।
হুমকি পাওয়া চিকিৎসক ডা. নাজিফা আনজুম নিশাত সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল দুপুর ২টা ৪৯ থেকে ২টা ৫১ মিনিটের মধ্যে ঘটনাটি ঘটে।’
কী ঘটেছিল জানতে চাইলে ডা. নাজিফা বলেন, ‘পেটে ব্যথা নিয়ে এক রোগী এলে আমি তাকে রিসিভ করি। এসময় রোগীর সঙ্গে অনেক মানুষ ছিলেন। রোগীর মেডিকেল হিস্ট্রি নিতে গিয়ে আমি তাদের মধ্যে একজন বা দুইজনকে থাকতে বলে বাকিদের বাইরে যেতে বলি। কিন্তু একজন এতে ক্ষেপে যায় এবং অকথ্য ভাষায় আমাকে গালাগালি করতে থাকে।’
তখন তাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন বাকিদের বাইরে যেতে বললে তিনজন থেকে বাকিরা বাইরে যান। কিন্তু যখনই রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করি সবাই এসে ভিড় করতে থাকে। তাদের আবার বাইরে যেতে অনুরোধ করলে একজন বলেন, ‘তোমার এমডিকে আমি কান ধরে এনে দাঁড় করাব, করো ট্রিটমেন্ট।’
তিনি কি বললেন আমি জানতে চাইতেই তিনি আঙ্গুল উঁচিয়ে বলেন, ‘কিছু বলি নাই, পেশেন্ট ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট। ট্রিটমেন্ট দাও।’
‘সব রোগীর জন্য চিকিৎসকদের চিকিৎসা একই রকম এবং সবার জন্য একই নিয়ম’, জানালে তিনি আমাকে তুই-তোকারি করা শুরু করেন। এরপর আমি সিনিয়রদের ঘটনাটি জানানোর জন্য বের হলে তিনি আমার পেছনে পেছনে আসেন এবং কোমর থেকে ছুরি বের করে বলেন, ‘তোর সাহস কত, লাশ ফেলে দেব।’ এরপর তিনি আরও অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন।
যারা রোগী নিয়ে এসেছিল তাদের কাউকে আপনি চেনেন কিনা প্রশ্নে ডা. নাজিফা বলেন, ‘তাদের কাউকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না।’
তাহলে সারোয়ার নাম কী করে জানলেন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তিনি নিজেই বলেছেন আমার নাম সারোয়ার। এখন তাদের অভিযোগ, আমি নাকি প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কূরুচিপূর্ণ কথা বলেছি, যেটা সম্পূর্ণ ভুল।’
এদিকে সিলেট ছাত্রলীগের একাধিক সূত্র সারাবাংলাকে জানায়, সারোয়ার চৌধুরী রোগী হিসেবে যাকে ছাত্রলীগ সভাপতি বলেছেন, তিনি আসলে তা নন। ওই রোগী সারোয়ারের কোনো বন্ধু হবে। প্রভাব ফেলার জন্যই তিনি ছাত্রলীগ সভাপতির মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলেন।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. ফেরদৌস আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে এখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু গতকাল আমাদের হাসপাতালে যেটা ঘটেছে তার ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন, খুব দুঃখজনক। যারা এসেছিল তারা ফ্লোরে ওঠার সময় লিফটম্যানকে চড় মেরেছে। কারণ লিফটম্যান তাদের লিফটে চেপে দাঁড়ানোর কথা বলেছিল। লিফটম্যান বেশ ব্যাথা পেয়েছেন। তার চোখ ফুলে গিয়েছে।’
‘রোজার সময় লিফটম্যানকে কে মারলো আমি দেখতে ছয়তলায় গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম হৈ-চৈ। খুব অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করছিল তারা, হুমকি দিচ্ছিল। আমি গিয়ে রোগী দেখলাম, তাদের সঙ্গে কথা বললাম। তখন যেসব গালাগালি হয়েছে সেগুলো খুবই ভয়ঙ্কর। তারা খুব খারাপ কথা বলছিল। সঙ্গে ছিল ভয় দেখনো, হুমকি।’
‘উইমেন্স মেডিকেল কলেজ তো, মেয়েই বেশি। চাইলেও সেভাবে প্রটেক্ট করতে পারি না।’ বলেন পরিচালক।
আমার মনে হয় তারা কোনো ইনটেনশন নিয়ে এসেছিল, যার কারণে আমি গতকাল কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি জানিয়ে পরিচালক বলেন, “তবে আজ হয়তো আমাকে সেটা করতে হবে। কারণ তারা মোবাইলে এখন পুরুষ চিকিৎসকদের ‘কল্লা কেটে ফেলবো’ বলে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।”
ডা. ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ‘মেয়েরা কিন্তু আমারই ছাত্রী। সেক্ষেত্রে আমার জন্য খুবই কষ্টকর একটা দিন যাচ্ছে। আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। আজ হয়তো একটা আইনগত ব্যবস্থা নেব। না হলে আসলে হচ্ছে না। কারণ গত তিনমাসে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে।’
তারা একই গ্রুপ কিনা জানতে চাইলে ডা. ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ‘কম-বেশি সবাই একই গ্রুপের।’
হুমকিদাতা দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সারোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘ওই ডাক্তার দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে নিয়ে কথা বলছে। তখন কি বলেন মাথা ঠিক রাখা যায়। তারপর তা নিয়ে আমাদের সঙ্গে একটু তর্কবিতর্ক হয়েছে। তারপরও আমি সরি।’
সভাপতির মিথ্যা পরিচয় দেওয়া নিয়ে তিনি বলেন, ‘রোগী আমাকে ছাত্রলীগের নেতা বলে পরিচয় দিয়েছিল। রোগী ছাত্রলীগের সভাপতি এমন কথা কেউই বলেনি। মেডিকেলের মালিকপক্ষের সঙ্গে আমার গুড সম্পর্ক। ওই এলাকায় আমার দীর্ঘদিনের যাওয়া-আসা। ঘটনার পরপরই মালিকপক্ষের লোকেরা আমাকে ফোন দেয়। ফোন দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমারে চলে যাওয়ার কথা বললে আমি সবাইকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের দাপট দিয়ে যদি ভেজাল করার ইচ্ছে থাকতো তাহলে তো একটা গ্লাস হলেও ভাঙচুর হতো। কিন্তু সেখানে সেরকম কিছু হয়নি। আসলে এখানে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ নিয়ে কথাবার্তা হয়নি। রোগী অসুস্থ। অথচ ওনারা ফেসবুক-পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত। ওসব দেখে পোলাপানের মাথা একটু গরম হয়ে গিয়েছিল।’
লিফটম্যানকে চড় মারার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের রোগী সিরিয়াস। কিন্তু লিফটম্যান বলে ওনাদের লোক আগে যাবে। বেয়াদবি না করলে কেউ আগে ভেজাল করে বলেন? পরে আমি লিফটম্যানরে একটা থাবা দেই। আমরা সিরিয়াস রোগী নিয়ে গেছি। আপনারা তো ভিডিওতে দেখছেন। ভিডিও ওনারাই করছে। আমরা একটু চিল্লাপাল্লা করছি। পোলাপান সঙ্গে ছিল অনেক। তখন কে কি করছে তা অত স্মরণে নাই।’
সারাবাংলা/জেএ/এমও