Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইন্দোনেশিয়ার যে গ্রামে ‘মা’ নেই!


১২ মে ২০১৯ ১৪:১০

এলি সুসিয়াওয়াতির বয়স যখন ১১ বছর, তখন আচমকাই তার বাবা-মা’র বিচ্ছেদ ঘটে। পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব পড়ে মায়ের ওপর। সে দায়িত্ব পূরণে গৃহপরিচারিকার কাজ নিয়ে তার মা চলে যান সৌদি আরব। এলিকে রেখে যান তার নানীর কাছে।

একইরকমভাবে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় কম বয়সি শিশুদের ফেলে জীবিকার খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয় হাজারো মা’কে। কোথাও কোথাও কোনো গ্রামের বেশিরভাগ শিশুকেই বেড়ে ওঠতে হয় মা ছাড়া। স্থানীয়ভাবে এসব গ্রাম বা সম্প্রদায় পরিচিত হয়ে ওঠে ‘মা-হীন গ্রাম’ হিসেবে। এসব গ্রামের তথ্যই ফুটে ওঠেছে বিবিসির এক বিশেষ প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রেবেকা হেন্সকি। পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটির সংক্ষিপ্ত অনূদিত রূপ তুলে ধরা হলো।

বিজ্ঞাপন

আমি যখন প্রথমবার এলিকে দেখি তখন সে স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রী। সে আমায় বলছিল, মা চলে যাওয়ার পর থেকে সে কতটা অসহায় হয়ে পড়ে। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের আঘাত তখনো শুকায়নি ভেতর থেকে।

এলি বলছিল, স্কুলে যখন বন্ধু-বান্ধবদের বাবা-মা’র সঙ্গে দেখি তখন খারাপ লাগে। আমি চাই মা বাড়ি ফিরে আসুক। মা আর দূরে থাকুক তা চাই না। আমি তাকে বাড়িতে দেখতে চাই। আমার ছোট ভাই-বোনদের দেখাশোনা করতে দেখতে চাই।

এলির গ্রাম- ওয়ানাসাবা, ইন্দোনেশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় লম্বক দ্বীপে অবস্থিত। পুরো গ্রামটি রাস্তার ধারে সারি সারি বাড়ি দিয়ে তৈরি। বাড়িগুলোর মাঝখানে ছোট্ট ব্যবধান গড়ে দিয়েছে সরু গলি। সেখানকার প্রথাটাই এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, শিশুদের উন্নত জীবন উপহার দেওয়ার জন্য মা’দের বিদেশে কাজ করাটা একরকম আবশ্যক। গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষই কৃষক বা দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। একজন নারী বিদেশে গৃহপরিচারিকা হিসেবে যে অর্থ আয় করেন তার এক ভাগও আয় করতে পারেন না পুরুষরা।

বিজ্ঞাপন

করিমাতুল আদিবিয়া

কোনো শিশুর মা যখন গ্রাম ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমায় তখন ওই শিশুকে দেখভালের দায়িত্ব পড়ে তার বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের ওপর। এছাড়া, পুরো গ্রামবাসীই ওই শিশুর যত্নের জন্য এগিয়ে আসে। কিন্তু নিজের মাকে বিদায় জানানো যেকোনো শিশুর জন্যই কঠিন। এরকম এক শিশুর নাম করিমাতুল আদিবিয়া।

করিমাতুল যখন মাত্র একবছর বয়সি, তখনই তার মা জীবিকার উদ্দেশ্যে গ্রাম ছাড়েন। মা সম্পর্কে কিছুই মনে নেই তার। সে যখন প্রাথমিক শিক্ষার শেষের দিকে তখন তার মা একবার ছুটিতে এসেছিলেন। কিন্তু ততদিনে করিমাতুল তার খালাকেই মা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। মা চলে যাওয়ার পর থেকে খালাই তাকে বড় করে তুলেছে।

করিমাতুল জানায়, আমি বিভ্রান্ত হয়ে গেছিলাম। আমার মনে আছে, মা কাঁদছিল। তিনি খালাকে বলছিলেন, আমার মেয়ে কেন জানে না, আম তার মা?

করিমাতুলের খালা জবাবে বলেছিলেন, তাদের কাছে করিমাতুলের মায়ের কোনো ছবি ছিল না। করিমাতুল তার সম্পর্কে একমাত্র তার নাম ও ঠিকানাই জানতো। সে বিবেচনায় তার এমন আচরণ করাটাই স্বাভাবিক।

করিমাতুল বলে, আমার ভেতরে তীব্র অনুভূতি হচ্ছিল যে, আমি প্রচণ্ডভাবে তার অভাব বোধ করেছি। কিন্তু একইসঙ্গে আমার রাগও হয়েছিল। আমাকে এত ছোট অবস্থায় রেখে তিনি কেন চলে গিয়েছিলেন?

করিমাতুলের বয়স এখন ১৩ বছর। প্রতিদিন রাতের বেলা সে তার মাকে ভিডিওকল দেয়। প্রতিদিন তাদের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদান হয়। কিন্তু সম্পর্কটা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয় ওঠেনি।

করিমাতুল বলে, মা যখন ছুটিতে গ্রামে আসলেও আমি আমার খালার সঙ্গেই থাকি। তিনি আমায় থাকতে বললেও আমি বলি, পরে আসবো।

করিমাতুল আদিবিয়া ও তার খালা

করিমাতুলের খালার নাম বোইক নুরজান্নাহ। তিনি এখন পর্যন্ত নয় জন শিশুকে বড় করে তুলেছেন। এর মধ্যে তার নিজের সন্তান মাত্র একজন। বাকি সবাই তার বিভিন্ন ভাই-বোনের সন্তান।

ইন্দোনেশিয়া থেকে নারীরা বিদেশে কাজ করতে যাওয়া শুরু করেন আশির দশকে। আইনি সুরক্ষা না থাকায় বাইরের দেশে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই নির্যাতনের শিকার হন। কেউ প্রচণ্ড মারধোরের শিকার হন। কেউ যৌন নির্যাতনের। কাওকে বেতন না দিয়েই দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কখনো কখনো কেউ নতুন সন্তান নিয়ে দেশে ফেরেন। বিদেশে থাকা অবস্থায় সম্মতিমূলক বা জোরপূর্বক মিলনের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া এসব সন্তানকে সহ্য করতে হয় নানা সমালোচনা।

স্থানীয় ভাষার এসব সন্তানকে ডাকা হয় আনাক ওলেহ-ওলেহ ডাকা হয়। মিশ্র জাতের হওয়ায় গ্রামের অন্যান্য শিশুদের মধ্যে তারা নজরকাড়া হয়। এমন এক কিশোরীর নাম ফাতিমাহ।

ফাতিমাহ

সে বলেন, লোকজন প্রায়ই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি দেখতে অন্যরকম। কেউ বলে, তুমি খুব সুন্দর! সম্ভবত তোমার বাবা আরব বলে। আমি খুশি হই।

কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, ফাতিমাহর মতো সকল মিশ্র জাতের শিশুরা খুশি হয় না। অনেককেই স্কুল ও অন্যান্য জায়গায় শুনতে হয় নানা সমালোচনা।

ফাতিমাহ কখনো তার আরব বাবাকে দেখেনি। কিন্তু তিনি তাদের জন্য নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। সে সুবাদে তার মা গ্রামেই থাকতে পারতেন। সম্প্রতি তার বাবার মৃত্যু হয়। এরপর পুনরায় জীবিকার সন্ধানে বাইরে যেতে হয় তার মাকে।

সারাবাংলা/আরএ

ইন্দোনেশিয়া বিদেশ মা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর