জোট থেকে ‘সিকি-আধুলি’ বাদ দিতে চায় বড় শরিকরা
১২ মে ২০১৯ ১৮:২৬
ঢাকা: ভাঙতে ভাঙতে ‘সিকি-আধুলি’-তে পরিণত হওয়া বিএনপি জোটের নাম সর্বস্ব দলগুলোকে বাদ দিয়ে জোট পুনর্গঠনের প্রস্তাব তুলতে যাচ্ছে অপেক্ষাকৃত ‘বড়’ দলগুলো। আগামীকাল সোমবার (১৩ মে) ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ বৈঠকে এ প্রস্তাব উত্থাপন করবে ‘বড়’ শরিকরা। গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ বৈঠক হবে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। ওই দিন থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো।
এর সাড়ে ৯ মাস পর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চার দলীয় জোট সম্প্রারণ করে ১৮ দলীয় জোট গঠন করা হয়। বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, লিবারেল ডেমোক্রেটি পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ, ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, পিপলস পার্টি (পিএল), ডেমোক্রেটিক লীগ (ডিএল) ও ন্যাপ ভাসানী— এই ১৮টি দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়।
২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই ১৮ দলীয় জোটে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল যোগ দিলে তা ২০ দলীয় জোটে রূপ নেয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ জাতীয় দল, পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ মাইনরিটি পার্টি ২০ দলীয় জোটে যোগ দেয়। এতে করে ২০ দলীয় জোটে শরিক দলের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩-এ।
গত ৬ মে ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ’র নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এই মুহূর্তে ২০ দলীয় জোটে শরিক দলের সংখ্যা ২২। এই ২২টি দলের মধ্যে ১৩টি দলের নিবন্ধন নেই। ৯টি দলের মূল অংশ জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর জোটের সংখ্যাতাত্ত্বিক নাম ঠিক রাখার জন্য দলগুলোর ভগ্নাংশ দিয়ে বিকল্প দল গঠন করে রেখেছে বিএনপি। আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোটে যোগ দেওয়া তিনটি দল স্রেফ সাইনবোর্ড সর্বস্ব— এমনটিই অভিযোগ বিএনপি জোটের পুরোনো শরিকদের!
জোট শরিকদের ভাষ্যমতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করায় ওই বছর আগস্ট মাসে জোট থেকে বেরিয়ে যান ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান প্রয়াত শেখ শওকত হোসেন নীলু, ন্যাপ ভাসানীর চেয়ারম্যান প্রয়াত শেখ আনোয়ারুল হক, মুসলীম লীগের মহাসচিব আতিকুল ইসলাম, ইসলামিক পার্টির মহাসচিব আব্দুর রশীদ প্রধান এবং এনডিপির মহাসচিব আলমগীর মজুমদার।
ওই সময় এনপিপির মহাসিচব ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে দিয়ে এনপিপি, গাইবান্ধা জেলা কল্যাণ পার্টির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলামকে দিয়ে ন্যাপ ভাসানী গঠন করে জোটে দলের সংখ্যা, তথা জোটের সংখ্যাতাত্ত্বিক নাম ঠিক রাখে বিএনপি। আর এনডিপি, মুসলীম লীগ ও ইসলামিক পার্টির মহাসচিব/সাধারণ সম্পাদকের পদে নতুন লোক বসানো হয়।
২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি বিএনপি জোটের তৃতীয় বৃহৎ শক্তি ইসলামী ঐক্যজোট জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে ২০ দল ছাড়ার ঘোষণা দেয়। দলটির চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ নেজামী, মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, নায়েবে আমীর মাওলানা হাসানাত আমিনীসহ শীর্ষ নেতাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ২০ দল ত্যাগ করে ইসলামী ঐক্যজোট।
ওই দিনই নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি অ্যাভোকেট মাওলানা আব্দুর রকিবকে সভাপতি ও মাওলানা আব্দুল করীমকে মহাসচিব করে বিকল্প ইসলামী ঐক্যজোট গঠন করা হয়। রাতে গুলশান কার্যালয়ে এই নতুন দলকে স্বাগত জানানোর সময় জোটের অন্যতম প্রধান শরিক জাগপা’র প্রয়াত সভাপতি শফিউল আলম প্রধান জোট নেত্রী খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেন, ‘নেত্রী, ম্যানুফেকচারড দল কারও জন্য শুভ হবে না।’
গত বছর ১৬ অক্টোবর বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে যায় জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ এবং খন্দকার গোলাম মোর্ত্তোজার নেতৃত্বাধীন এনডিপি। সদলবলে বেরিয়ে যাওয়া এই দুই নেতা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন মহাজোটে যোগ দেন।
আর তাদের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য ঢাকা মহানগর ন্যাপের সাংগঠনিক সম্পাদক শাওন সাদেকীকে দিয়ে ‘বিকল্প’ বাংলাদেশ ন্যাপ এবং এনডিপির সহসভাপতি কারী আবু তাহেরকে দিয়ে ‘বিকল্প’ এনডিপি গঠন করে বিএনপি— এমনটিই অভিযোগ জোট শরিকদের।
এ ছাড়া দুই ভাগে বিভক্ত বাংলাদেশ লেবার পার্টির হামদুল্লাহ আল মেহেদীর অংশ নির্বাচনের আগে যোগ দেয় মহাজোটে। মনোনয়ন না পেয়ে ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাঈফুদ্দিন আহমেদ মণি আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন। শুধু তাই নয়, জোটের শরিক দল হওয়া সত্ত্বেও আরেকটি দলের প্রতীক ও ব্যানার নিয়ে নির্বাচন করেন তিনি।
এদিকে, আন্দালিভ রহমান পার্থ জোট ছাড়ার পরপরই বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বিএনপিকে আলটিমেটাম দেন। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ছেড়ে না আসলে বাংলাদেশ লেবার পার্টি নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জোটের সংখ্যাতাত্ত্বিক নাম ঠিক রাখার জন্য জোট ত্যাগ করা শরিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী দিয়ে নতুন দল গঠন, আরেক দলের তৃণমূল নেতাকে দিয়ে বিকল্প দল তৈরি, জোটের সঙ্গে থেকে জোটবিরোধী অবস্থানের পরও কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়া, নাম সর্বস্ব শরিক দলের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, জোটের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ বিএনপি জোটের অপেক্ষাকৃত পুরনো ও বড় দলগুলো। তাই তারা এর একটা প্রতিকার চান। পুনর্গঠন চান জোটের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহম্মদ ইবরাহিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপির নেতৃত্বে বাস্তবসম্মত আকৃতির জোট চাই। আমরা চাই জোটের পুনর্গঠন।’
জোটের কাঠামো কেমন হবে?— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মিডিয়াতে প্রকাশ্যে সেটা বলব না। জোটের ফোরামে বলব।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জোটের আরেক শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমেদ বীর বিক্রম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।’
তবে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ’২০ দলীয় জোটে এমন কিছু শরিক দল আছে, যাদের মূল্য সিকি-আধুলির সমানও না। আমরা চাই এদেরকে বাদ দিয়ে নিবন্ধিত এবং সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী দলের সমন্বয়ে জোট পুনর্গঠন হোক। যারা প্রত্যেকেই মর্যাদার সঙ্গে জোটে অবস্থান করবে।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর