চট্টগ্রামে অসহনীয় যানজটে নাকাল নগরবাসী, পুলিশও অসহায়
২২ মে ২০১৯ ১২:১৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: রমজানের মাঝামাঝিতে এসে চট্টগ্রাম নগরীর যানজট পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সকাল থেকে শুরু হওয়া যানজট দুপুর আর ইফতারের সময় গড়িয়ে গভীর রাত পর্যন্ত ঠেকছে। তীব্র গরমের মধ্যে গণপরিবহনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
খোদ নগর পুলিশের কর্মকর্তারাই বলছেন, চট্টগ্রাম নগরীর যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। দিনের প্রায় ১৫ থেকে ১৮ ঘন্টা যানজটে স্থবির হয়ে থাকছে বন্দরনগরী।
অসহনীয় এই যানজটের জন্য তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ। এগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম বন্দরে হঠাৎ পণ্য ডেলিভারি ও ট্রাক-কাভার্ডভ্যন প্রবেশ বেড়ে যাওয়া, ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি এবং গুরুত্বর্পূণ দু’টি সড়কের চলমান সংস্কারকাজ।
বন্দরের বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে বিমানবন্দর সড়ক। আর ওয়াসার রাস্তা কাটার প্রভাব আছে পুরো নগরজুড়ে। সড়ক সংস্কারের ফলে যানজট বিস্তৃত হয়েছে এ কে খান মোড় হয়ে সিটি গেইট দিয়ে ঢাকামুখী মহাসড়কেও। এছাড়া রমজান উপলক্ষে ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়াকেও যানজটের জন্য বিবেচনায় আনছেন ট্রাফিক কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম নগরীর যানজট পরিস্থিতি নিয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি-বন্দর) ফাতিহা ইসলাম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্দরে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান প্রবেশের পরিমাণ গত তিনদিন ধরে অস্বাভাবিকভাবে প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। এতো গাড়ি রাখার জায়গা বন্দরের ভেতরে নেই। ১০-১২টি গাড়ি ঢোকার পর তারা জেটি গেইটগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। সেসব গাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকছে। তাহলে অন্য গাড়ি চলবে কিভাবে?’
ফাতিহা ইসলাম আরও বলেন, ‘বিমানযাত্রীদের কীভাবে আমরা বারিক বিল্ডিংয়ের মোড় থেকে ইপিজেড পর্যন্ত সড়ক পার করছি, সেটা আমরাই জানি। রাতের ২টা-৩টা পর্যন্ত যানজট থাকছে। সকালে অফিসসময় শুরুর পর আবার শুরু হয় যানজট।’
ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বন্দরমুখী গাড়ির চাপ বেড়ে যাওয়ায় রোববার সকাল ৮টার পর নগরীর বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে শুরু হওয়া যানজট রাত দেড়টা পর্যন্ত ছিল। একটি বাস বারিক বিল্ডিং থেকে ইপিজেডের দিকে আনুমানিক চার কিলোমিটার এলাকা পার হতে একঘন্টারও বেশি সময় লাগার তথ্য আছে তাদের কাছে। সোমবারও দিনভর যানজট ছিল যা গভীর রাত পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে।
মঙ্গলবার (২১ মে) সকাল থেকে আবারও শুরু হয় বন্দরকেন্দ্রিক যানজট, যা দুপুর তিনটার দিকে কিছুটা শিথিল হলেও ইফতারের পর সন্ধ্যা থেকে আবারও শুরু হয় বলে জানান ডিসি ফাতিহা।
বন্দরে গাড়ি আসা-যাওয়া হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে বন্দরে ডেলিভারি প্রায় তিনদিনের মতো বন্ধ ছিল। সেসময় আটকে পড়া পণ্যগুলো এখন দ্রুততার সাথে ডেলিভারি হচ্ছে। এরপর রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে ভোগ্যপণ্য ডেলিভারিও এখন বেশি। দিনে যদি এক কনটেইনার পণ্য বেশি ডেলিভারি হয় তাহলে তো অতিরিক্ত তিনটি ট্রাককে বন্দরে ঢুকতে হচ্ছে। ৫০ কনটেইনার পণ্য বেশি ডেলিভারি হলে ১৫০ ট্রাক বেশি ঢুকতে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এই চাপটা আমাদের সামলাতে হচ্ছে।’
বন্দর এলাকার বাইরে মঙ্গলবার দুপুর থেকে নগরীর লালখান বাজার, ওয়াসা, জিইসি মোড়, এ কে খান মোড়, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে যানবাহনের অস্বাভাবিক চাপ। প্রখর রোদ ও তীব্র গরমের মধ্যে বিভিন্ন মোড়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে বাস, অটোরিকশা, রিকশাসহ বিভিন্ন গণপরিবহনকে। সড়কে যানবাহনের গতিও ছিল শ্লথ।
বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস’র (বিএসআরএম) কর্মকর্তা এস এম আবু ইউসুফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘রমজানের আগে নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায় অফিস থেকে লালখান বাজারে পৌঁছতে সময় লাগত সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট। এখন ৪৫ মিনিটেও আসতে পারি না। জিইসি মোড়, ওয়াসা এবং লালখান বাজার মোড়ে সারাক্ষণ জ্যাম।’
এসব এলাকায় যানজটের জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি ও কয়েকটি সড়কে চলমান সংস্কারকাজকে কারণ হিসেবে তুলে ধরছেন ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা। ওয়াসা নগরজুড়ে পানি সরবরাহ লাইন স্থাপনের জন্য রাস্তা কাটছে। নগরীর এমন কোনো মূল সড়ক, অলিগলি নেই যেখানে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি চলছে না। এজন্য যানজট মূল সড়ক ছাড়িয়ে অলিগলিতেও ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা।
সূত্রমতে, গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিনদিন ধরে ওয়াসা নগরীর বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে ফকিরহাট পর্যন্ত সড়কের একপাশ বন্ধ রেখে পাইপলাইন সংস্কারের কাজ করে। এসময় বন্দরের গাড়ির চাপের সঙ্গে সড়কের একপাশ বন্ধ হয়ে যাওয়া যোগ হয়ে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে।
এছাড়া নগরীর বহদ্দারহাট মোড় থেকে সিঅ্যান্ডবি, কাপ্তাই রাস্তার মাথা হয়ে কালুরঘাট পর্যন্ত সড়কের একপাশ সাড়ে তিন বছর ধরে বন্ধ রেখেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এর ফলে কালুরঘাট সেতু হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী এবং মোহরা হয়ে কাপ্তাইমুখী যানবাহনগুলো ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটে আটকে থাকছে।
চট্টগ্রামের নাগরিক সংকট নিয়ে কাজ করা সংগঠন নাগরিক উদ্যোগের আহ্বায়ক খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ওয়াসার ব্যবস্থাপনার পরিচালকের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করে বলেছি- রাস্তা কাটার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনার জন্য। ওয়াসা সারাশহর খুঁড়ে রেখেছে আর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। চার লেইন সড়কে চলার সমপরিমাণ গাড়ি যদি সিঙ্গেল লাইন দিয়ে চলতে হয়, তাহলে যানজট তো হবেই।’
সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এক সভায় মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ওয়াসার খোড়াখুঁড়ি নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বিশ রোজার পর থেকে তাদের আর রাস্তা কাটতে না দেওয়ার ঘোষণা দেন।
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) হারুন অর রশীদ হাযারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওয়াসার কারণে শুধু মূল সড়কে যানজট হচ্ছে, তা-ই নয়, অলিগলিতেও হচ্ছে। এত তীব্র রোদের মধ্যে মূল সড়কের গাড়ি চলাচলের শৃঙ্খলা আনতেই যেখানে আমরা হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে অলিগলির যানজট কিভাবে সামলাবো? রমজানে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক ও শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে আমরা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় সেসব উদ্যোগের সুফল আমরা পুরোপুরি দিতে পারছি না। অথচ আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।’
এদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের জন্য কাটগড় থেকে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত সড়কের খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে। সড়কের মাঝখানে চলছে পাইলিংয়ের কাজ। দুই পাশে সরু লেইনে চলছে যানবাহন। বিমানবন্দর সড়কের সিমেন্ট ক্রসিং থেকে রুবি সিমেন্ট কারখানা পর্যন্ত অংশেও চলছে সংস্কার কাজ। এতেও সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।
নগরীর আগ্রাবাদ এক্সেস রোড এবং পোর্ট কানেকটিং রোড সংস্কার করে নতুন করে নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। সড়ক দু’টির অবস্থা গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে এমন হয়েছে, সেখানে গাড়ি চলাচল করছে চরম ঝুঁকি নিয়ে ধীরগতিতে। এর প্রভাব পড়ছে ইপিজেড-বন্দরকেন্দ্রিক সড়ক এবং একে খান-সিটি গেইট হয়ে ঢাকামুখী মহাসড়কে।
নাগরিক উদ্যোগের আহ্বায়ক ও নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ইপিজেড-বন্দরকেন্দ্রিক হাজার হাজার গাড়ি এক্সেস রোড ও পোর্ট কানেকটিং সড়ক দিয়ে চলাচল করে। অথচ বছরের পর বছর ধরে এই সড়কগুলো চলাচলের অনুপযোগী হয়ে আছে। এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, বিকেলের পর থেকে নগরজুড়ে ফুটপাতে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন হকাররা। ফুটপাত ছেড়ে হকাররা গভীর রাত পর্যন্ত সড়কেও ভাসমান দোকান নিয়ে বসছেন। এতে সড়কে যানবাহন চলাচলের পথ সংকুচিত হয়ে আসছে।
যানজটের কারণে গাড়ি আটকে থাকায় বিকেলে অফিসছুটির পর ঘরমুখো মানুষকে গণপরিবহন সংকটে পড়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে গাড়ির জন্য অপেক্ষমাণ মানুষের ভিড় এখন প্রতিদিনের চিত্র।
সারাবাংলা/আরডি/এসএমএন
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামে যানজট বারিক বিল্ডিং মোড় যানজট