জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি ৯ মাসের মালিহা। ঠাণ্ডা-জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত হয়ে মালিহা বেশ কয়েকদিন ভোগার পর তাকে নিয়ে মোহাম্মদপুর থেকে গত ২৪ নভেম্বর ঢামেক হাসপাতালে এসেছেন মা মরিয়ম বেগম। প্রথমে জরুরি বিভাগে এলেও মালিহার সংক্রমণ বেশি হওয়াতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মরিয়ম বেগম সারবাংলাকে বলেন, ডাক্তাররা বলছেন, শীতের এই সময়ে বাতাসের ধুলা থেকে মেয়ের নিউমোনিয়া হয়েছে। কেবল মরিয়ম বেগমই নন, ঢামেক হাসপাতালের শিশু বিভাগে এখন ভর্তি হওয়া অনেক শিশুই বায়ুজনিত অসুখে ভর্তি। চিকিৎসকরা বলছেন, ঋতু পরিবর্তনের শীতের এই সময়টাতে ঢাকার বাতাসে দূষনের মাত্রা বাড়ে, সেই সঙ্গে যোগ হয় গাড়ি এবং কলকারাখানার কালো ধোঁয়াসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ। আক্রান্ত শিশুদের যদি সময়মতো সঠিকভাবে চিকিৎসা না করালে স্থায়ীভাবে আক্রান্ত হবার সুযোগ থেকে যায়।
অপরদিকে, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে তিনমাসের জুনায়েদকে নিয়ে গত ২ অক্টোবর থেকে অবস্থান করছেন মা সোনিয়া খাতুন। ঢাকার বাসাবো থেকে আসা সোনিয়ার সঙ্গে কথা হয় গত ২৮ নভেম্বর। এতো ছোট ছেলেকে নিয়ে হৃদরোগ হাসপাতালে কেন জানতে চাইলে সোনিয়া বলেন, ওর হৃদপিণ্ডে ছিদ্র ধরা পড়েছে, তাই এখানে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আরও কয়েকদিন থাকার পর চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেবেন পরবর্তী করণীয় সর্ম্পকে।
শরীয়তপুরের গোসাইরহাট থেকে আসা সাড়ে সাত বছরের কবিতা কাজ করত স্থানীয় এক ইটভাটায়। আর সেখানে কাজ করতে গিয়েই হৃদরোগে আক্রান্ত হয় কবিতা। গত ৯ দিন ধরে খালা শিল্পী বেগম কবিতাকে নিয়ে রয়েছেন হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাপসাতালে।
শিল্পী বেগম বলেন, শরীয়তপুরের ডাক্তাররা ইটভাটার কালো ধোঁয়াকে কবিতার অসুখের জন্য দায়ী বলে কবিতাকে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য এ হাসপাতালে পাঠায়। তারপরই এখানে নিয়ে আসি কবিতাকে, এখন তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের হিসাব বলছে, প্রতিদিনই এখানে বাতাসজনিত দূষণে আক্রান্ত হয়ে আসা রোগীদের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, শীতকালে বাতাসে সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেট ম্যাটারের (সূক্ষ কণা-পিএম) মাত্রা বেড়ে যায়। অধিদফতর থেকে জানা যায়, ঢাকার বাতাসের মান এখন লাল ক্যাটাগরির যা কিনা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বর্তমান হারে যদি বাতাস দূষিত হতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে ঢাকা ও চট্রগ্রামসহ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরকে ধোঁয়ার কারণে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বের ৯১ টি দেশের ১ হাজার ৬০০ শহরের মধ্যে বাতাসজনিত দূষিত ২৫ টি শহরের মধ্যে বাংলাদেশের ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়নগঞ্জ অন্যতম। নারায়ণগঞ্জের অবস্থান ১৭ তম, গাজীপুর ২১তম এবং ঢাকা ২৩তম।
চিকিৎসকরা বলছেন, শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়াতে বায়ু দূষণের ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সূক্ষকণার মাত্রা ২ দশমিক ৫ হলে তা ফুসফুস পর্যন্ত প্রবেশ করে আর মাত্রা ১০ হলে সেটি শ্বাসনালিতে আক্রমণ করে। তারা বলছেন, বাতাসে এ সুক্ষকণার মাত্রা বাড়ার ফলে শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থদের সর্দি, কাশি, হাঁপানি, এলার্জি এবং শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। কার্বন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইড বেড়ে যাওয়াতে ফুসফুসে ক্যান্সারও হতে পারে। বাতাসে ভাসতে থাকা সীসা শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধিতে বাধা দেয়।
ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে বায়ু দূষণজনিত রোগে বছরে সাড়ে আট হাজার শিশু মারা যায়। কালো ধোঁয়ায় থাকা বস্তুকণা ও সালফার ডাই-অক্সাইডের প্রভাবে ফুসফুস, ব্রংকাইটিস, কিডনির জটিলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি রয়েছে। নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও সিসার কারণে শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস হতে পারে।
প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, আমরাতো সাধারণভাবে ঢাকার বাতাসকে ‘বিষ’ বলে থাকি। এই বাতাসে একদিকে যেমন বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মিশে আছে তেমন রয়েছে কল-কারখানাসহ পরিবহনের কালো ধোঁয়া। আর এতে সব বয়মী মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন গর্ভবতী নারী ও শিশুরা। গত কয়েক বছরে হাসপাতালগুলোতে কালো ধোঁয়া ও দূষিত বাতাসের কারনে অসুখে আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলেও মন্তব্য করেন ডা. লেলিন চৌধুরী।
ঢাকা হাসপাতালের এক জরিপে উঠে এসেছে,যেসব শিশুরা বস্তিতে কিংবা রাস্তার পাশে বেড়ে ওঠে তারা মাত্রাতিরিক্ত ভাবে সীসা দূষণের শিকার হয়।আর এই সীসা দূষণের কারনে শিশুরা রক্তশূণ্যতায় ভোগে। এতে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের মেধা বিকশিত হয় না ঠিকমতো, যার কারনে তারা জাতী গঠনেও ঠিকমতো ভূমিকা রাখতে পারে না বলে মন্তব্য করেন ডা. লেলিন চৌধুরী।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার সারাবাংলাকে বলেন, বায়ু দূষণের সবচেয়ে বড় প্রভাব গিয়ে পড়ে একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতি। দূষিত বায়ুর প্রভাবে তার গর্ভে থাকা শিশুটি আক্রান্ত হয়। বাতাসে যদি মাত্রাতিরিক্ত সীসার অবস্থান থাকে সেটা একজন গর্ভবতী মা এবং তার গর্ভের সন্তানকে মারাত্মকভাবে সারাজীবনের জন্য আক্রান্ত করে।
যদি কোনো গর্ভবতী নারী যদি দীর্ঘমেয়াদি বায়ু দূষণের শিকার হন, তাহলে ক্রমাগত তারা অক্সিজেনের ঘাটতিতে থাকবেন, তারা সিওপিডি (ক্রনিক অবসট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ)তে আক্রান্ত রোগী হবেন। আর এর ফলে তার গর্ভে থাকা সন্তানটি অপরিণত নবজাতক হিসেবে জন্ম নেবে ।
ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার আরও বলেন,এসব অপরিণত নবজাতকদের জন্মগতভাবেই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বেশি থাকে। এসব শিশুরা হার্টে ছিদ্র, হার্টে বাড়তি রগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে-এভাবেই তারা হৃদরোগী হয়ে যাবে একসময়। চিকিতসকরা আরো জানান, এই বায়ুদূষণ আমাদের জীবনে এমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে যে খুব দ্রুত যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা না করা যায় তবে ভবিষ্যত প্রজন্ম একটি অসুস্থ প্রজন্ম হিসেবে বেড়ে উঠবে।
সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ