দাম অর্ধেক, লবণ নিয়ে বিপাকে চাষিরা
২৪ মে ২০১৯ ১১:৫৮
কক্সবাজার থেকে ফিরে: কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার কোটাাখালীর লবণ চাষি আনিসুর রহমান। তিনি এ বছর ২০ কানি (এক কানি ৩৯ শতাংশ) জমিতে লবণ চাষ করছেন। লবণের দাম কম হওয়ায় লাভ তো দূরের কথা, খরচ উঠবে কি না, তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।
এখানকার আরেক লবণ চাষি জাকির হোসেনসহ সব চাষিরই একই অবস্থা। তারা বলছেন, তিন মাস আগে মাঠ থেকে যে লবণ বিক্রি করতেন ২৮০ টাকা মণ দরে, সে লবণের দাম এখন প্রায় অর্ধেকে নেমে ১৫০ টাকা হয়েছে। লবণের ন্যায্য দাম পেতে এখন সরকারের হস্তক্ষেপের আশায় রয়েছেন তারা। দাবি উঠেছে লবণ বোর্ড গঠনেরও।
চাষিরা বলছেন, বড় বড় কোম্পানিগুলো লবণ কেনা বন্ধ রাখার কারণেই লবণের এই দরপতন। জানা গেছে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) সম্প্রতি বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের নমুনা পরীক্ষা করে যে ৫২টি পণ্যকে নিম্ন মানের বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ৯টি লবণের ব্র্যান্ড। বিএসটিআইয়ের ওই তালিকা প্রকাশের পর আদালত এই পণ্যগুলোকে বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন, পাশাপাশি এসব পণ্যের উৎপাদনও বন্ধ রাখতে বলেছেন। এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতেই এসিআই, মোল্লা সল্ট, তীর, মধুমতি, মদিনা, দাদা সুপার, স্টারশিপ, নূর স্পেশাল ও তাজ— এই ৯টি লবণ কোম্পানি আর লবণ কিনছে না। তারই প্রভাবে লবণ চাষিদের পড়তে হচ্ছে আশঙ্কার মুখে।
স্থানীয়রা বলছেন, চকরিয়া উপজেলার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ এলাকায় লবণ চাষ হয়। বড় ও নামি-দামি কোম্পানিগুলো লবণ না নেওয়ায় চাষি পর্যায়ে লবণ বিক্রি অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে লবণ মাঠে হাজার-হাজার মণ লবণ অবিক্রিত পড়ে আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসিআই সল্ট লিমিটেডের বিজনেস ডিরেক্টর মো. কামরুল হাসান বলেন, আমাদের কারখানার জন্য প্রতিদিন প্রায় ছয় লাখ কেজি লবণ সংগ্রহ করে থাকি। কিন্তু আদালতের নিষেধাজ্ঞায় উৎপাদন বন্ধ থাকায় আমরা খুচরা বাজার থেকে লবণ কেনা বন্ধ রেখেছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে লবণ কেনা চালু করতে পারব।
লবণ চাষি মো. ফারুখ হোসেন সারাবাংলাকে জানান, এক কানি জমিতে ২৫০ মণ লবণ চাষ হয়। জমি তৈরিতে ২৭ হাজার টাকা, মাটিতে পলিথিন বিছাতে ১০ হাজার ৫০০ টাকা, জমিতে পানি দিতে খরচ হয় তিন হাজার টাকা। নিজের শ্রমের মূল্যসহ আনুষাঙ্গিক আরও কিছু খরচসহ এক কানি জমিতে খরচ হয় ৪৫ হাজার টাকা।
ফারুখ হোসেন বলেন, এসব অঞ্চল থেকে এসিআই সল্ট লিমিটেড, মোল্লা সল্ট, মধুমতিসহ বড় ও নামি-দামি কোম্পানিগুলো লবণ কিনে থাকে। কিন্তু বর্তমানে এসব কোম্পানি লবণ কেনা বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছি। এখনকার বাজারমূল্যে লবণ বিক্রি করতে হলে লাভ তো দূরের কথা, প্রতি কানি জমিতে ঘাটতিই থাকবে প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকা। নিজের পাঁচ কানি জমিতে লবণ চাষ করে প্রায় ৪০ হাজার টাকা ক্ষতি হলে তা পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, চলতি মৌসুমে ১৬ লাখ টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও এরই মধ্যে উৎপাদন ছাড়িয়েছে ১৮ লাখ টন। রেকর্ড লবণ উৎপাদনের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত লবণ কোম্পানিগুলো লবণ কেনা কমিয়ে দেওয়ার কারণে দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। লবণের দরপতনের কারণে ব্যাপক লোকসানের মধ্যে পড়ায় লবণ বিক্রি করছেন না বলে জানান এসব এলাকার কৃষকরা।
এ পরিস্থিতিতে লবণ শিল্প বাঁচাতে হলে সরকারের কাছে ‘লবণ বোর্ড’ গঠনের দাবি জানিয়েছেন লবণ চাষিরা। লবণ চাষিরা যেন ঠিকমতো দাম পান, সে বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব থাকবে এ বোর্ডের ওপর। পাশাপাশি লবণ কোম্পানিগুলো কোনো জটিলতায় পড়লে সেক্ষেত্রেও এই বোর্ড চাষিদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করবে।
লবণ চাষি আনিসুর রহমান আরও বলেন, আমার চার হাজার মন লবণ মজুদ আছে। গর্ত করে মাঠেই রেখেছি। কিভাবে লবণের দাম বাড়ানো যায়, সরকার যেন সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে দেশে ভোক্তা ও শিল্পখাতে লবণের চাহিদা রয়েছে ১৬ লাখ ৬৫ হাজার টন। বিপরীতে বিসিক দেশে লবণ উৎপাদন এলাকার ৬৪ হাজার ১৪৭ একর জমিতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১৮ লাখ টন। গত বছরের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, টেকনাফ, কক্সবাজার সদরসহ কক্সবাজারের উপকূল এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীর উপজেলায় লবণ উৎপাদনে জড়িত রয়েছে প্রায় ৪ লাখের বেশি কৃষক ও শ্রমিক। অনূকূল আবহাওয়া থাকায় ১৩টি লবণ উৎপাদন মোকামের অধীনে লবণ উৎপাদন ছাড়িয়েছে ১৮ লাখ টন।
বিসিক কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, এ অঞ্চলের কৃষকরা সাধারণত ডিসেম্বর থেকে শুরু করে মে মাসের শেষ পর্যন্ত লবণ চাষ করে থাকেন। এ পর্যন্ত প্রায় ১৮ লাখ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। আগামী কয়েক দিনে তা আরও বাড়তে পারে।
সারাবাংলা/জেজে/টিআর