নতুন রূপে সড়কে ফিরছে ‘ফিটনেসবিহীন’ বাস
২৬ মে ২০১৯ ০৬:২৮
ঢাকা: রাজধানীর অধিকাংশ ওয়ার্কশপ বা গাড়ি মেরামতের কারখানায় এখন দারুণ ব্যস্ততা। সবখানেই চলছে পুরোনো ফিটনেসবিহীন লক্কর-ঝক্কর বাসগুলোকে রাঙানোর কাজ। হাতুড়ি পিটিয়ে সমান করা হচ্ছে বাসগুলোর বডি, তারপর তাতে দেওয়া হচ্ছে নতুন রঙ। এসবের পরে সেগুলো পরিণত হচ্ছে চকচকে ‘নতুন’ গাড়িতে।
প্রতিবছরই ঈদযাত্রায় লঞ্চ ও ট্রেনের পাশাপাশি যাত্রীদের বাড়তি চাপ থাকে বাসে। আর এ সুযোগটাই কাজে লাগান বাস মালিকরা। সারাবছরের ত্রুটিযুক্ত বাসগুলোকে নতুন মোড়কে সাজিয়ে পরিবেশনের এই তো সময়। ঈদযাত্রায় প্রয়োজন প্রচুর যানবাহন, তা অপ্রতুল থাকায় বাস মালিকরা নতুন বোতলে পুরোনো মদের মতো নতুন চেহারায় পথে নামান পুরোনো বাসগুলোকে। যেগুলোর হয়তো ফিটনেসই নেই, সেগুলোই স্রেফ রঙের ছোঁয়ায় চালিয়ে দেওয়া হয় নতুন বাস হিসেবে।
তবে ফিটনেসবিহীন বাসে রঙ করে পথে নামানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন পরিবহনের মালিকরা। তাদের দাবি ফিটনেস আছে, কিন্তু রঙ ফিকে হয়ে গেছে এমন বাসই কেবল রঙ করে পথে নামানো হচ্ছে।
ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে নামানো হলে শাস্তির ব্যবসা রয়েছে বলে জানিয়েছে বিআরটিএ। পুলিশের দাবি, সারাদেশে শুরু হয়েছে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান। তাই কেউ চাইলেই ঈদযাত্রায় যেকোনো ধরনের বাস চালাতে পারবে না।
শনিবার (২৫ মে) রাজধানীর মিরপুর ১, ২ ও মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ, বসিলা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঈদযাত্রার ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। সারি সারি ফিটনেসবিহীন গাড়ি যেখানে খালি জায়গা পেয়েছে সেখানেই দাঁড়িয়ে রঙের কাজ হয়েছে। কোনো কোনো গাড়িতে টুংটং লোহার পিটুনির শব্দ পাওয়া গেলেও অধিকাংশ গাড়িতেই দেখা গেছে রঙের কাজকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। রঙের কাজে নিযুক্ত শ্রমিকরাও এখন দম ফেলার ফুসরত পাচ্ছেন না। দিনরাত গাড়ির রঙের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
বসিলার রঙমিস্ত্রি আবু হানিফ সারাবাংলাকে বলেন, প্রতিবছর ঈদ এলেই কাজের চাপ বেড়ে যায়। অনেকে ঈদের দুই-তিন মাস আগ থেকেই চুক্তি করে রাখে। ২৫-২৬ রমজানের মধ্যেই কাজ শেষ করার তাগিদ থাকে। তাই এ সময়ের আগেই তারা চেষ্টা করেন কাজ শেষ করতে। তাই আবহাওয়া ভালো থাকলে রাতদিন কাজ করেন তারা।
একটা গাড়ি দুই-তিনজনে মিলে রঙ করলে এক থেকে দেড় দিন লাগে কাজ শেষ করতে। খরচ হয় ৮/১০ হাজার টাকা। গত সপ্তাহে দ্বীপন, সিটিবাস, প্রজাপতিসহ বিভিন্ন কোম্পানির বাস মেরামতের কাজ করেছেন বলেও জানান আবু হানিফ।
আরেক রঙমিস্ত্রি ফারুক আলম বলেন, ‘যেগুলোর কাজ করেছি সেগুলোর ফিটনেস আছে কি নাই, আমরা তো তা জানি না। আমাদেরকে বলে রঙ করে দিতে, তাই করি। কিন্তু দুয়েকটা গাড়ি রঙ করার সময় দেখি অন্য মেকানিকরা ইঞ্জিনের কাজও করে। কিন্তু বেশিরভাগই দেখি শুধু রঙ করায়। শুধু বসিলায় না, এমন কাজ কেরানীগঞ্জ, ডেমরা গাজীপুরা এবং সাভারের এদিকেও চলে এখন। সবাই গাড়ির রঙের কাজে ব্যস্ত।’
বসিলার রঙের গ্যারেজে কথা হয় প্রজাপতি পরিবহনের একজন মালিক পলাশের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিআরটিএ আমাদেরকে বছরে একবার ফিটনেস সনদ দেয়। কিন্তু নানা কারণে গাড়ির রঙ তিন থেকে চার মাসের বেশি থাকে না। ট্রাফিক পুলিশ লাঠি দিয়ে গাড়ির বডিতে পিটায়, লাইনম্যানরা পিটায়। আবার অন্য গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ঘষাঘষিও হয়। এসব কারণে বছরে তিন থেকে চারবার রঙ করি। তবে ঈদ উপলক্ষে একটু দেখতে যেন সুন্দর লাগে, সে জন্য সবাই চেষ্টা করে রঙ করতে। এতে ফিটনেসবিহীন হওয়ার মতো কোনো কিছু তো আর হয় না।’
তবে কিছু কিছু মালিক আছেন যারা ফিটনেস না থাকলেও বাস রঙ করিয়ে রাস্তায় নামান বলে অভিযোগ করলেন পলাশ। তার অভিযোগ, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ম্যানেজ করে চলে এই কাজ। যার বদনামটা পড়ে পুরো পরিবহন সেক্টরে। তাই এদেরকে নিয়ন্ত্রণে বিআরটিএ ও পুলিশকে আরও তৎপর হওয়ার পরামর্শ দেন এই মালিক। সেই সঙ্গে যাদের ফিটনেস সনদ আছে এবং গাড়িও উপযুক্ত, তাদেরকে যেন হয়রানি না করা হয় সে অনুরোধ করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবহন বাস মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমরা যথেষ্ট নজরদারি করছি যেন ঈদযাত্রায় যাত্রীদের কোনো দুর্ভোগ না হয়। তাই ফিটনেসবিহীন কোনো বাস যেন সড়কে না চলতে পারে, সেজন্য আমরা বিআরটিএ ও পুলিশ প্রশাসনকে যথেষ্ট সহযোগিতা করব। শুধু ঈদ যাত্রায় নয়, কোনো সময়ই যেন ফিটনেসবিহীন বাস না চলতে পারে, সেজন্য আমরা সোচ্চার রয়েছি।’
বিআরটিএ প্রতিবছর যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা করে জানিয়ে সংস্থাটির উপ-পরিচালক মাসুদ রহমান বলেন, যারা নিয়ম মানতে চায় না, সড়কে ফিটনেসবিহীন পরিবহন চালাতে চায়, তাদের আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া ট্রাফিক পুলিশকে সতর্ক থাকতেও অনুরোধ জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ আহমেদ বলেন, সড়কে যেন ফিটনেসবিহীন পরিবহন চলাচল করতে না পারে সেজন্য পুলিশ বছরব্যাপী সোচ্চার থাকে। নিয়মিত পরিবহনে কাগজপত্র চেকিং করা হয়। তবুও ঈদ উপলক্ষে পুলিশ আরও বেশি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ভোগ এড়াতে এরই মধ্যে দেশের সব ট্রাফিক পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যেন কোনোভাবেই ফিটনেসবিহীন ও লাইসেন্সবিহীন চালক পরিবহন নিয়ে চলাচল করতে না পারে।
সারাবাংলা/এসএইচ/এসএমএন