Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মাতৃত্বে এক অভিশাপের নাম ফিস্টুলা


২৮ মে ২০১৯ ০৬:১৫

ঢাকা: মাতৃত্বে এক অভিশাপের নাম ফিস্টুলা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তাদের মতে, এই অভিশাপ নির্মূল করা গেলে শতকরা ৮ ভাগ মায়ের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হবে। বর্তমানে দেশে ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত নারী প্রায় ১৯ হাজার ৭৫৫ জন। প্রতি বছর নতুন করে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রায় ১ হাজার নারী।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে গড়ে প্রতিদিন প্রসবজনিত কারণে মারা যান ১৪ জন নারী। আর এই ১৪ জনের মধ্যে শতকরা ৮ ভাগ নারীর মৃত্যু হয় বাধাগ্রস্ত বা বিলম্বিত প্রসবের কারণে।

বিজ্ঞাপন

এখনো দেশে মাত্র ৪০ শতাংশ প্রসব হয় দক্ষ হাতে। আর অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত হাতে প্রসব করাতে গিয়ে ফিস্টুলায় আক্রান্ত হচ্ছেন মায়েরা।

সাধারণত বাল্যবিয়ে, অপুষ্টিতে ভোগা, কম বয়সে গর্ভধারণ, অপ্রশিক্ষিত দাইয়ের হাতে বাড়িতে প্রসব, স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব, সুস্থ নারী স্বাস্থ্য গড়ে ওঠে না- এসব কারণে ফিস্টুলা হয়ে থাকে।

আগামী ২০৩০ সাল বা তার আগেই বাংলাদেশকে ‘ফিস্টুলা ফ্রি’ দেশ হিসেবে ঘোষণা করার অঙ্গীকার রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে প্রসবজনিত ফিস্টুলা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে অস্ত্রোপচারসহ অন্যান্য কারণে ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ২০ লাখ নারী ফিস্টুলায় আক্রান্ত। শতকরা ৫ ভাগ প্রসব বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নতুন করে প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় এক লাখ নারী এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

বাংলাদেশে ফিস্টুলা নিয়ে কাজ করছে এনজেন্ডার হেলথ বাংলাদেশ। তাদের ফিস্টুলা কেয়ার প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি হাজার বিবাহিত নারীর মধ্যে ফিস্টুলায় আক্রান্ত ১ দশমিক ৭ জন। মোট ২৪ থেকে ৪০ শতাংশ রোগী ফিস্টুলায় আক্রান্ত হয়েছেন অস্ত্রোপচারজনিত কারণে। বাকিরা বাধাগ্রস্ত প্রসবের কারণে।

বিজ্ঞাপন

অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জরায়ু অপসারণজনিত অস্ত্রোপচারে ফিস্টুলায় আক্রান্তের হার বাড়ছে। ফিস্টুলা নিরাময়যোগ্য রোগ হলেও অবহেলা এবং রোগ গোপন করার প্রবণতার কারণে ফিস্টুলা রোগীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন। যদিও বাংলাদেশে ফিস্টুলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কেন্দ্রের সংখ্যা হাতে গোনা।

শামীমা আক্তারের যখন বিয়ে হয়, তখন তার বয়স সাড়ে ১৫ বছর। বিয়ের পরপরই গর্ভধারণ করে সে। তবে শামীমাকে কোনো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাননি স্বামী রেজাউল। নানা জটিলতা দেখা দিলে মাদারীপুরের প্রত্যন্ত একটি গ্রামের হাসপাতালে শামীমাকে ভর্তি করা হয়। ওই দিন তার প্রসব হয়নি, কেবল রক্তক্ষরণ হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করে রেজাউল তার স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে যান। পরদিন দুপুরে আবারও শামীমাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তখন তার বিলম্বিত প্রসব হয়, একটি মৃত সন্তানের জন্ম হয়। শামীমাকে হাসপাতালে রেখেই রেজাউল চলে আসেন। শ্বশুর বাড়িতে তার আর জায়গা হয়নি, জায়গা হয় বাবার বাড়ির গোয়াল ঘরে। মৃত সন্তান জন্মের পরেই শামীমা আক্তার ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন।

কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, একজন নারীর জীবন বিপন্ন করে দেয় ফিস্টুলা। একজন নারী যখন মা হবেন, তখন তার প্রত্যাশা থাকে তিনি এবং তার সন্তান সুস্থ থাকবেন। একবার ফিস্টুলা হলে প্রস্রাব এবং পায়খানা ঝরতে শুরু হয়। আর এটা নিয়েই তাকে বাঁচতে হয়। তাকে কেউ কাজে ডাকে না, পাশে দাঁড়ায় না। সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি বলেন, অস্ত্রোপচারের কারণে ফিস্টুলায় আক্রান্তের হার বাড়ছে। আগে ছিল শতকরা ৫ ভাগের কম, এখন সেটা বেড়ে ২৫ থেকে ৩০ ভাগে দাঁড়িয়েছে।

বিলকিস বেগম চৌধুরী মনে করেন, এই সমস্যা মোকাবিলায় জোরালোভাবে দুইটি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। যারা ইতোমধ্যেই ফিস্টুলায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের চিকিৎসা করতে হবে, অস্ত্রোপচার করতে হবে। যদি সারিয়ে তোলা না যায় তাহলে রিহ্যাবিলিটেশনের ব্যবস্থা করে সহযোগিতা করতে হবে। অন্যদিকে, গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসবপরবর্তী সময়ে নারীদের সঠিক যত্ন নিতে হবে। কী কী কারণে ফিস্টুলা হতে পারে, হলে কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে হবে। বর্তমানে সরকারি ১১টি এবং বেসরকারি ৮টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে বিনামূল্যে ফিস্টুলার অস্ত্রোপচার হয়।

এনজেন্ডার হেলথ বাংলাদেশের ফিস্টুলা কেয়ার প্লাস প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ডা. শেখ নাজমুল হুদা বলেন, ১৮ বছর বয়স না হলে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ অপরিণত বয়সে সন্তানের জন্মদান মায়ের ফিস্টুলার অন্যতম কারণ। আর মনে রাখতে হবে, ফিস্টুলা প্রতিরোধে প্রশিক্ষিত ধাত্রীদের মাধ্যমে সন্তান প্রসব অত্যন্ত জরুরি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফিস্টুলা সেন্টারের প্রকল্প উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. সালেহা বেগম চৌধুরী অস্ত্রোপচারের চেয়ে প্রতিরোধের ওপর জোর দিয়ে বলেন, প্রতিরোধ করতে না পারলে ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা বাড়বে। একটি তথ্যের প্রচার দরকার, প্রসব বেদনা ওঠার ১২ ঘণ্টার মধ্যে সন্তানের জন্ম না হলে গর্ভবতী নারীকে জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালে নিতে হবে।

সারাবাংলা/এটি

নিরাপদ মাতৃত্ব ফিস্টুলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর