৩০০ টাকা মণেও মিলছে না ধানের ক্রেতা
২৮ মে ২০১৯ ০৭:৩৩
ঠাকুরগাঁও: বাজারে চাহিদা না থাকায় ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। ঠাকুরগাঁওয়ে ৩০০ টাকা মণেও ধান বিক্রি করতে পারছেন না তারা। লাভ তো দূরের কথা খরচের টাকাও ঘরে তুলতে পারছেন না বলে অভিযোগ তাদের। কৃষকরা বলছেন, ৮ টাকা কেজি দরেও ধান বিক্রি করা যাচ্ছে না। আগামী বছর থেকে তারা আর ধানই চাষ করবেন না।
ধানের দাম না থাকা ও কৃষি ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের দাবিতে কৃষক সংগঠনগুলো কর্মসূচিও পালন করছে। ঠাকুরগাঁওয়ে সড়ক অবরোধ করে ধান ছিটিয়ে বিক্ষোভও করেছে কৃষক-ক্ষেতমজুর সংগ্রাম পরিষদ।
আন্দোলনকারীরা বলেন, ‘ধানের বিক্রয় মূল্য উৎপাদন খরচের থেকে কম হওয়ায় কৃষকরা মারাত্মক সংকট ও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। কিন্তু কৃষকদের বাঁচাতে সরকার পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিচ্ছে না।’
সংশ্লিষ্টরা জানায়, জেলায় ধানের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় এবার কিছুটা বেড়েছে। গত বছর প্রতি হেক্টরে ধান উৎপাদন হয়েছিল ৩.৮ মেট্রিক টন, এবার তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪ টনে দাঁড়িয়েছে। জেলায় এবার বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬২ হাজার ৩৬০ হেক্টর। আর অর্জিত হয়েছে ৬২ হাজার ৩৫০ হেক্টর বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। সে হিসেবে এবার জেলায় ধানের উৎপাদন হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন।
তবে আশানুরূপ ফলন হলেও ধানের দাম না থাকায় লোকসানের মুখে পড়েছেন চাষিরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমন মৌসুমের ধানই গুদামে রয়েছে। ফলে বোরো ধান ক্রয়ে তেমন আগ্রহ নেই তাদের। তাই বাজারে ধানের চাহিদা একদমই নেই।
জানা যায়, ঠাকুরগাঁওয়ে ১ হাজার ৬৯০টি হাসকিং মিল ও ১৭টি অটোরাইস মিলের মাধ্যমে মাত্র ৩০ হাজার ৬১৯ টন চাল ও ১ হাজার ৮৫৭ টন ধান ক্রয় করবে সরকার। যা উৎপাদনের তুলনায় খুবই সামান্য।
জেলায় ধানের দাম কম থাকার কারণ হিসেবে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে দায়ী করেছেন ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম এই সদস্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘তার সময়ে (কামরুল ইসলাম) থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর পরিমান চাল আমদানি করায় সরকার বেকায়দায় পড়েছে। সরকারের ইচ্ছা থাকলেও জায়গার অভাবে এখন ধান-চাল কেনা সম্ভব হচ্ছে না।’
তবে স্থানীয় কৃষক নেতা মাহাবুব আলম রুবেল অভিযোগ করেছেন, সরকার মিলারদের স্বার্থই দেখছে। তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যা ও উত্তরাঞ্চলে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেওয়ায় ধানের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অজুহাতে চালকল মালিকরা সিন্ডিকেট করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে। চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকরা সরকারকে চাল দেয়নি ওই বছর। অথচ এই মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’
সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের কশাল বাড়ি গ্রামের লুৎফর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে জেলার হাট-বাজারগুলোতে প্রতি মণ ধান ৩০০-৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ প্রতি মণ ধান উৎপাদনে খরচ পড়েছে ৬০০-৬৫০ টাকা। এভাবে ধানের দাম প্রতিবার কম পাওয়ায় আমরা লোকসানে পড়ি। আমরা ধান চাষ করাই বন্ধ করে দেবো।’
ঠাকুরগাঁও জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান রাজু বলেন, ‘বিদেশ থেকে চাল আমদানি না করে প্রকৃত মিলারদের নির্বাচিত করলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে। এতে কৃষক তার ধানের ন্যায্য দাম পাবেন। ভিজিডি, জিআর, কাবিখা ও টিআর কর্মসূচির আওতায় হতদরিদ্র ও দুঃস্থদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল কিনে ডিও ব্যবসায়ীরা সর্টার করে এলএসডিতে দিচ্ছে। এই অনিয়ম বন্ধ করা উচিৎ। তা হলে কিছুটা হলেও কৃষকের দুঃখ লাঘব হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। গত আমন মৌসুমের ধান এখনো মিলারদের কাছে মজুদ থাকায় ধান কেনার আগ্রহ নেই তাদের মধ্যে। মিলাররা যে পরিমাণ বরাদ্দ পেয়েছে তাতে গত মৌসুমের ধান শেষ হবে না। তবে সরকার যদি আরও বরাদ্দ দেয় তাহলে ধানের দাম কিছুটা বাড়তে পারে।’
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. আফতাব হোসেন বলেন, ‘ধান উৎপাদনের জন্য কৃষি উপাদন সময় মতো পাওয়ায় ও কৃষি বিভাগের পরামর্শে চাষিদের ধান উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বর্তমান বাজারে ধানের যে দাম তাতে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এসব ধান শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে পরে লাভবান হতে পারবে কৃষকরা।’
এছাড়া সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ধান চাষিদের তালিকা প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দেওয়া হয়েছে। আশা করি দ্রুতসময়ে ধান-চাল কেনা শুরু হবে। ব্যবসায়ীরা ধান কেনা শুরু করলে বাজার স্থিতিশীল হতে পারে বলেও জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এই উপ-পরিচালক।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. বাবুল হোসেন জানান, ঠাকুরগাঁওয়ে ধান সংগ্রহ শুরু হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই চাল সংগ্রহও শুরু করা হবে। তবে বৈরী আবহাওয়া ধান-চাল কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সারাবাংলা/এমও