মাতৃমৃত্যুর ৪৩ শতাংশই কিশোরী মা
২৮ মে ২০১৯ ১২:৩৫
ঢাকা: বর্তমানে দেশে প্রতি লাখ জীবিতসন্তান জন্মে মারা যাচ্ছেন ১৭২ জন মা ,যাদের মধ্যে কিশোরী মায়ের সংখ্যাই বেশি। অথচ টেকসই লক্ষমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ৭০ বা তার নিচে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু দেশে এখনও ১৫ বছর বা এর কম বয়সী মায়ের সংখ্যা বাড়ছেই। যাদের মাতৃত্বকালীন ঝুঁকি অনেক বেশি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের তথ্যমতে ,দেশে ৪৩ শতাংশ কিশোরী মা গর্ভজনিত ও প্রসবসংক্রান্ত জটিলতার কারণে মারা যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন কিশোরী মা কখনোই সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারে না। তাদের মতে মাতৃমৃত্যুর এই হার কমিয়ে আনতে হলে প্রথমেই বাল্যবিয়ে কমাতে হবে। পাশাপাশি কিশোরী মায়েদের মৃত্যু ঝুঁকি কমাতে তাদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে।
এমনি পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার ( ২৮ মে) পালিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। দিবসটিতে এবারের প্রতিপাদ্য ‘মর্যাদা ও অধিকার, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসূতি সেবার অঙ্গীকার।’
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের এমসিএইচ-সার্ভিসেস ইউনিটের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. জয়নাল হক জানান, বাংলাদেশ বাল্যবিয়ের হার বর্তমানে ৫৯ শতাংশ। এর মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছরের কিশোরীদের শতকরা ৩১ শতাংশ গর্ভবতী হয়। আর বাল্য বিয়ের কারণে গর্ভধারণের ফলে কিশোরী মায়ের মৃত্যুহারও বেশি। তিনি জানান, কিশোরী মায়েদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ কিশোরী মা সন্তানের জন্মদানের কারণে মারা যায়।
ইউনিসেফের তথ্য মতে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের মা হওয়ার মৃত্যুঝুঁকি ২০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের চেয়ে দ্বিগুণ। অন্যদিকে ১৫ বছরের কম বয়সী মায়েদের প্রসবজনিত মৃত্যুঝুঁকি পাঁচ গুণ বেশি। এছাড়া বাল্যবিয়ে ও গর্ভধারণে মা ও নবজাততের অসুস্থতা ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এ রকম গর্ভধারণের কারণেই অনেক ক্ষেত্রেই কম ওজনের শিশুর জন্ম হয় আর ওই শিশুর জীবনে পুষ্টিহীনতার চক্র শুরু হয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন নারীর গর্ভাবস্থায়, প্রসবাবস্থায় এবং সন্তান প্রসবের ৪২ দিনের মধ্যে প্রসবসংক্রান্ত জটিলতার কারণে মৃত্যু হলে সেটি মাতৃমৃত্যু হিসেবে ধরা হয়। একলামশিয়া( খিঁচুনি), রক্তক্ষরণ, ডায়াবেটিস, অকাল গর্ভপাত, উচ্চ রক্তচাপসহ বাড়িতে প্রসবের কারণেই এই মাতৃমৃত্যু হচ্ছে। বাড়িতে প্রসবের কারণে ৫৪ শতাংশ, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ১৪ শতাংশ, রক্তক্ষরণে ৩১ শতাংশ আর ২৪ শতাংশ মা মারা যাচ্ছে খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়ে।
তারা বলছেন, প্রসবের ২৪ ঘন্টার মধ্যে মারা যান ৫৫ শতাংশ আর বাকী ৪৫ শতাংশ মা মারা যাচ্ছেন প্রসবের ৪২ দিনের মধ্যে। আর মাত্যৃমৃত্যুরোধে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, বাড়াতে হবে সচেতনতা। আর এই সচেতনা বাড়াতে, বর্তমানে ১১২টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র থেকে জরুরি প্রসূতি সেবাসহ ২০৩টি কিশোর-কিশোরী কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে বয়ঃসন্ধীকালীন স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা, বাল্য-বিয়ের কুফল ও কিশোরী গর্ভধারণের কুফল বিষয়ে কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
কিশোরী মায়ের মৃত্যুর বিষয়ে কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ২২ থেকে ৩০ বছর বয়স গর্ভধারণের জন্য উপযুক্ত সময়। এর আগে গর্ভধারণ করলে মা নানা ধরণের জটিলতায় ভোগে। যার কারণে তাদের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি থাকে। একইসঙ্গে বাল্য বিয়ে ও গর্ভধারণ মা ও সন্তান দুজনকেই অসুস্থ করে তোলে। এতে বাড়ে মৃত্যুঝুঁকিও।
ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী আরও বলেন, কেবল প্রজনন স্বাস্থ্য নয়, ‘সুস্থ নারী স্বাস্থ্যে’ জোর দিতে হবে। গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়েদের স্বাস্থ্যসেবায় নজর দিতে হবে। গর্ভকালীন সময়ে কমপক্ষে মোট চারবার ১৬ সপ্তাহ, ২৮ সপ্তাহ, ৩২ সপ্তাহ ও ৩৬ সপ্তাহে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, পরামর্শ মতো চলতে হবে। এসময়ে এন্টিনেটাল চেকআপ অবশ্যই জরুরি। অথচ আমরা পুরোপুরি সবাইকে নিতে পারছি না বলে মন্তব্য করেন ডা. বিলকিস। তিনি বলেন, ইন্সটিটিউশনাল ডেলিভারি অথবা ‘স্কিল্ড বার্থ অ্যাটেন্ডেন্ট’ বা দক্ষ, প্রশিক্ষিত ধাত্রীর হাতে সন্তানের জন্ম হওয়াটাও মাত্যৃমৃত্যু রোধে গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এসব ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে শতকরা ৮০ ভাগও নিশ্চিত করতে পারছি না, যা কীনা নিরাপদ মাতৃত্বে বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।
ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী বলেন, কিশোরী মায়েদের মৃত্যুর বিষয়টি ‘আইডেন্টিফাই’ করা অত্যন্ত জরুরি। যদি কোনও কারণে বিয়ে হয়েই যায় সেক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে সঠিক সময়ে এবং সঠিক উপায়ের বিষয়ে জোর নজর দিতে হবে। এখানে সরকার থেকে শুরু করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা-সব সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে।
জানতে চাইলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা কাজী মোস্তফা সারোয়ার জানান, দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাউন্সিলিংয়ের কাজ চলছে । আর এ জন্য কাউন্সিলিং সেন্টারও করা হয়েছে। কোথাও যদি বাল্যবিয়ে হয়েও যায় তাহলেও যেন ২০ বছরের আগে সন্তানের জন্ম না হয় সে বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে।
স্কুল গুলোতে অষ্টম থেকে দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করছেন ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার কর্মীরা। পাশাপাশি বাল্যবিয়ে ও অল্প বয়সে সন্তানের জন্মের বন্ধে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে, বলেন ডা. কাজী মোস্তফা সারোয়ার।
সারাাবাংলা/জেএ/জেডএফ