বিএনপি আমলেই ‘ধামাচাপা পড়ে’ জিয়া হত্যা মামলা
৩০ মে ২০১৯ ১৮:৩৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ৩৮ বছর আগে ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বিপথগামী একদল সেনা সদস্যের হাতে প্রাণ হারান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। তবে ওই মামলাকে পাশ কাটিয়ে সামরিক আদালতে বিচার করে ফাঁসি দেওয়া হয় অভিযুক্ত ১৩ সেনা কর্মকর্তার। পরে বিএনপি দুইদফা ক্ষমতায় এলেও প্রকাশ্য আদালতে বিচারের জন্য কোতোয়ালী থানায় দায়ের হওয়া মামলাটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএনপির প্রথমদফা শাসনামলে কার্যত ‘ধামাচাপা’ অবস্থায় ছিল মামলাটি। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আদালতের নির্দেশে সিআইডি’র মাধ্যমে তদন্ত করে মামলাটি পুনরুজ্জীবীত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিএনপি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাগ্রহণের আগমুহূর্তে সিআইডি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে মামলাটি নিষ্পত্তির আবেদন করে। কিন্তু এরপর পাঁচবছর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষ সিআইডির চূড়ান্ত প্রতিবেদনের কোনো নারাজি আবেদন আদালতে দাখিল করেনি।
সেসময় চট্টগ্রাম আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী আইনজীবীরা বলেছেন, বিএনপি নেতাদের অসহযোগিতার কারণে জিয়াউর রহমান হত্যা মামলার বিচার হয়নি। বেসামরিক আদালতে বিচারের জন্য দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত সংক্রান্ত সব নথি বিএনপির প্রথমদফা শাসনামলে গায়েব করে ফেলা হয়। পরবর্তীতে সিআইডি তদন্ত করতে গিয়ে ঘটনার কোনো আলামত, লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনও খুঁজে পায়নি।
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এই মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ ১৭৩ বার সময় বাড়ানোর আবেদন করে, আদালতও সময় বাড়ান, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে মনে করেন সেসময়কার রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা জানান, মামলাটি এখনও পুনরুজ্জীবীত করা সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পট-পরবর্তীতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়া সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ২৯ মে চট্টগ্রাম আসেন। তার এ সফরের লক্ষ্য ছিল স্থানীয় বিএনপির বিরোধী মীমাংসা করা। কিন্তু সফরের পরদিন ৩০ মে ভোরে সার্কিট হাউসে একদল সেনাসদস্যের গুলিতে জিয়াউর রহমান মারা যান। একইসঙ্গে নিহত হন রাষ্ট্রপতির দেহরক্ষী কর্নেল আহছান, রউফ, গার্ড রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হাফিজ, ড্রাইভার হাফিজুর রহমান ও পুলিশ কনস্টেবল দুলাল।
এ ছাড়া আহত হন পুলিশ কনস্টেবল বেলায়েত হোসেন, মুছলিম আহমেদ, রাষ্ট্রপতির দেহরক্ষী নায়েক রফিক, সিপাহী শাহ আলম, আবদুল হাই সরকার, মঈনুদ্দিন, সিভিল ড্রাইভার আমির হোসেন, পি ডব্লিউ ডি ক্লার্ক আবদুল বাতেন। আবদুল বাতেন পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
এ ঘটনায় ওই বছরের ১ জুন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন সহকারী কমিশনার মোকাররম হোসেন বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় মামলা করেন। মামলায় সেনাবাহিনীর চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর এবং কর্নেল দেলোয়ার হোসেন, লে. কর্নেল ফজলে হোসেন, মেজর মনির, মেজর দোস্ত মহম্মদ, মেজর মোজাফফর, মেজর রেজাউল করিম, ক্যাপ্টেন রফিক, ক্যাপ্টেন ইলিয়াছ ও ক্যাপ্টেন জামিউল হকসহ মোট ১০ জনকে আসামি করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার আবদুল হাকিম খান মামলাটির প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। মামলা দায়েরের প্রায় দুইবছর পর আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৩ সালের ১০ এপ্রিল মামলাটি আদালতের বিচারিক নথিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
এরপর ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। বিএনপি আমলের পুরো সময় মামলাটির তদন্তভার ছিল নগর পুলিশের হাতে। এ পাঁচ বছরে তদন্তের জন্য আদালতে সময়ের আবেদন ছাড়া আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মামলাটি আবারও পুনরুজ্জীবীত হয়। ওই বছরের ১৭ ফেব্রুযারি পর্যন্ত ১৪৩ কার্যদিবসে কোনো প্রতিবেদন না পেয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছ থেকে এ বিষয়ে ব্যাখা চান আদালত। ১৯৯৭ সালের ৩১ মার্চ নগর পুলিশের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আদালতে পাঠানো জবাবে বলা হয়, ‘১৯৮১ সালের ১৬ জুন (বিএনপির রাষ্ট্রপতি আব্দুস ছাত্তারের আমলে) আইসিসি মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেনাকর্তৃপক্ষ মামলাটি তদন্ত করেছে, তাই পুলিশের আর তদন্তের প্রয়োজন নেই।’
সে সময় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী বর্তমানে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কামাল উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশের জবাবে আমরা তাজ্জব হয়ে যাই। কারণ ওই সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। পরে এরশাদের আমল এমনকি পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হলেও এ আদেশ রহিত করে বেসামরিক আদালতে বিচার শুরুর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উপরন্তু আমরা যখন মামলাটি পুনরুজ্জীবীত করার চেষ্টা করছি, তখন এই ধরনের আদেশের তথ্য পেয়েছি।’
‘সেদিনের ঘটনায় জিয়াউর রহমান শুধু একাই মারা যাননি। পুলিশ মারা গেছে, বেসামরিক লোক মারা গেছে। জিয়াউর রহমান নিজেও তখন বেসামরিক লোক ছিলেন, যদিও প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি অনুসারে তিনি সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। তাহলে বেসামরিক আদালতে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না কেন ? আমরা আদালতে পুলিশের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করি’ বলেন প্রবীণ এই আইনজীবী।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, নগর পুলিশের জবাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন তৎকালীন মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) এ কে এম কামাল উদ্দিনও।
১৯৯৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সিএমএম এ মামলার বিষয়ে একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আদেশ দিয়ে সেটি আবারও পুনরুজ্জীবীত করে। আদেশে তিনি বলেন ‘যেহেতু সামরিকের পাশাপাশি বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন এবং ঘটনার সঙ্গে বেসামরিক কেউ জড়িত ছিলেন কিনা তা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’ আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। ১৯৯৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার কাদের খান তদন্তভার গ্রহণ করেন।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কামাল উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয়, তখন সার্কিট হাউসে তার দলের মহাসচিব এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও ছিলেন। তাদেরসহ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা চিঠি ইস্যু করেছিলেন। তিনি আদালতে সময়ের আবেদন করার সময় চিঠি ইস্যুর বিষয়টি অবহিত করেছিলেন। কিন্তু বিএনপির একজন নেতাও তদন্তকারী কর্মকর্তার ডাকে সাড়া দেননি বলে আমরা পরে জানতে পেরেছি।’
সে সময় চট্টগ্রাম আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী বর্তমান মহানগর পিপি ফখরুদ্দিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় জিয়াউর রহমান হত্যা মামলার বিচারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তৎপর ছিল। কারণ, বিএনপি প্রথমবার ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর সিআইডি যখন মামলা তদন্তের দায়িত্ব নিল, তখন তারা আগের প্রয়োজনীয় নথিপত্রও পায়নি অথচ সঠিক তদন্ত হলে এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা ষড়যন্ত্রকারী ছিল, আরও কারা এর সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের মোটিভ কি ছিল, সেটা জানা যেত।’
২০০১ সালের ১ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াত জোট জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া। এর ২৪ দিন আগে ৬ সেপ্টেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে সিআইডি।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কামাল উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্তে চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়। সিআইডি কেন তড়িঘড়ি করে এটা করল, সেটা আমরা জানি না। তবে ধারণা করা যায়, সরকার পরিবর্তন হলে দেশের পরিস্থিতি পাল্টে যাবে, এমন ধারণা থেকেই তারা ঝামেলা এড়াতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারে। কিন্তু বিএনপি যখন পরে পাঁচবছর ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা (রাষ্ট্রপক্ষ) তো নারাজি দিয়ে মামলাটি পুনরুজ্জীবীত করতে পারত।’
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর পিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বর্তমানে নগর বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার। নারাজি আবেদন দাখিল করেননি কেন, জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘মামলার সব আসামি যেহেতু সামরিক ব্যক্তি, একই ঘটনায় যেহেতু একবার সামরিক আদালতে বিচার হয়েছে, আরেকবার একই মামলা বিচারের জন্য আদালতে নেওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল না। বেসামরিক কেউ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল কি-না সেটাও তদন্তে প্রমাণ হয়নি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়েছিল এবং সেটি আদালতে গৃহীত হয়েছিল। এরপরও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ (৪) ধারা অনুযায়ী যে কোনো সময় মামলাটি পুনরুজ্জীবীত করা যাবে।’
সারাবাংলা/আরডি/একে