জাকিয়া আহমেদ
ঢাকা: বেসরকারি হাসপাতাল স্কয়ারের এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর পিত্তথলিতে পাথর অপসারণ করতে গিয়ে ডিওডেনাম (পাকস্থলীর ঠিক নিচে ক্ষুদ্রান্তের প্রথম অংশ) ফুটো করে ফেলেছেন। এতে এখন প্রাণ বাঁচানো দায় হয়ে পড়েছে ওই রোগীর। ঘটনা ঢাকতে অস্ত্রোপচারের সময়ে ভিডিও হওয়া সিডিও দেওয়া হয়নি পরিবারকে।
এ রোগীর নাম মো. নজরুল ইসলাম। তিনি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং ধানমণ্ডি রেভিনিউ সার্কেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সম্প্রতি তাকে সরকারি কর্ম কমিশনে প্রেষণে সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
নজরুল ইসলামকে এখন দ্রুত দেশের বাইরে পাঠাতে হবে। অথচ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া ৩৫ লাখ টাকা, মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে আইসিউতে অগ্রিম ডিপোজিট করতে হবে ২৫ লাখ টাকা। এছাড়াও রয়েছে চিকিৎসার অন্যান্য খরচ। যেটা নজরুলের পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।
সিঙ্গাপুরে কেনো নিতে হবে জানতে চাইলে নজরুল ইসলামের স্ত্রী সারাফ আনিকা হক মৌরি সারাবাংলাকে বলেন, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, নজরুলের অন্ত্রের ছিদ্রটি সিল করতে হলে ওপেন সার্জারি করতে হবে। যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তাদের পরামর্শ হলো, সিঙ্গাপুরে এমন প্রযুক্তি রয়েছে যা দিয়ে লেজারের মাধ্যমে সিল করা সম্ভব। এ কারণেই আমরা সেখানে যেতে চাচ্ছি।
তিনি জানান, স্কয়ার কর্তৃপক্ষ কেবল তার স্বামীর ভুল চিকিৎসাই করেনি, তা নিয়ে মিথ্যাচার যেমন করেছে, তেমনি তথ্য গোপন করে অযথা সময় ক্ষেপণ করেছে। ফলে নজরুল ইসলামের অবস্থা এখন শঙ্কটাপন্ন।
এদিকে স্কয়ারের চিকিৎসক এম এম আরেফিন তার ভুল চিকিৎসার কথা স্বীকার করেছেন। সেই সঙ্গে নিশ্চিত হওয়া গেছে, পিত্তথলিতে অপারেশন চালাতে গিয়ে তিনি ভুল করে নজরুল ইসলামের অন্ত্র ফুটো করার বিষয়টিও।
নজরুল ৩০তম বিসিএস পাসের পর প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে বিভিন্ন জেলায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করে আসছেন ।
মৌরি সারাবাংলাকে জানান, গত ১৭ জানুয়ারি পিত্তথলির পাথর অপসারনের জন্য স্কয়ার হাসপাতালে গ্যাস্ট্রো অ্যান্ট্রোলজি বিভাগে অধ্যাপক ডা. এমএস আরেফিনের অধীনে ভর্তি হন নজরুল ইসলাম। ওইদিন বিকাল ৫ টার সময় তার অস্ত্রোপচার হয়। পরের দিনই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার কথা থাকলেও স্কয়ার তাকে রিলিজ করছিলো না। দুই দিন পর দেখা গেল তার হাত পা হলুদ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও তার বিলিরুবিন বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ কমে যায়।
মৌরি বলেন, এরপর যখন চিকিৎসকের কাছে জানতে চাই, রোগীর আসলে কী হয়েছে। তখন চিকিৎিসক এম এম আরেফিন আমাদের বলেন, অস্ত্রোপচারের সময় সুঁই এর খোঁচা লেগেছে। তাই এমনটা হতে পারে।
চিকিৎসকের স্বীকারোক্তির পর বিষয়টি পরীক্ষা করিয়ে পরিবার নিশ্চিত হয়, নজরুলের অন্ত্র ছিদ্র হয়ে গেছে। ততোদিনে নজরুলের পুরো শরীরে ইনফেকশন দেখা দেয়, জন্ডিসেও আক্রান্ত হন তিনি। এসব রোগের কোনও চিকিৎসাও স্কয়ার থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে ২৩ জানুয়ারি পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ি নজরুলকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. তৌহিদুল ইসলামের অধীনে তার চিকিৎসা হয় এবং গত ২৯ জানুয়ারি একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। কিন্তু ডিওডেনাম ক্ষত নিয়ে তারা কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলেন না। অবস্থার অবনতি হলে গত সোমবার তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়।
আনিকা হক মৌরি বলেন, আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন নজরুল ইসলাম। তাকে রক্ত দেওয়া হলেও রক্ত শরীরে থাকছে না,পায়খানার সঙ্গে এবং নাক ও মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে যাচ্ছে।
অথচ স্কয়ার হাসপাতালে থাকার সময় চিকিৎসকসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুরোটাই বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু তারা পুরো ঘটনাই চেপে রাখতে চাইছিলেন।
মৌরি বলেন, পরে হাসপাতালের ১৫ থেকে ২০ জন চিকিৎসকের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। সেখানে আমরা বলেছি, ভুল হতেই পারে, কিন্তু সেটা কেনো রোগীর স্বজনদের কাছে গোপন করা হলো। গোপন করার কারণে আমার স্বামীর অবস্থা এখন আশঙ্কাজনক অবস্থায় চলে গেল, তার দায়দায়িত্ব কে নেবে?
ক্ষুব্ধ মৌরি আরো বলেন, ওরা আমার স্বামীর সঠিক চিকিৎসা করেনি। উপরন্তু বিষয়টি আড়াল করতে গিয়ে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। দিনের পর দিন তাকে হাসপাতালের বেডে শুইয়ে রেখেছে। অস্ত্রোপচারের পরদিন যে মানুষটার হাসপাতাল ছাড়ার কথা, সেই মানুষটা আজ আইসিইউতে-এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা। তার চিকিৎসা এখন দেশে নেই, তাকে নিতে হবে সিঙ্গাপুরে- এর দায় কী স্কয়ার কর্তৃপক্ষ নেবে?
মৌরি জানান, স্কয়ার কর্তৃপক্ষ কেবল ভুল চিকিৎসা দিয়ে তথ্য গোপন করেছে তাই নয়। তারা মিথ্যাচার করেছে আমাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত ২২ জানুয়ারি অধ্যাপক আরেফিনের কাছে ডকুমেন্টস হিসেবে অস্ত্রোচারের সময়কার ভিডিও চাওয়া হয়। কিন্তু তখন অধ্যাপক আরেফিন খুব খারাপ ব্যবহার করেন। তিনি হুমকি দিয়ে ‘আপনাদের উদ্দেশ্য কি’ বলে আধাঘণ্টা সময় চান। অথচ আধাঘণ্টা পরে আমাদেরকে জানানো হয়, সেই ভিডিও ডিলিট হয়ে গিয়েছে, ভিডিও হাসপাতালের কাছে নাই। যে হাসপাতাল ভুল চিকিৎসা করে, তথ্য গোপন করে, মিথ্যাচার করে, স্বজনদের হুমকি দেয় সে প্রতিষ্ঠান কী করে এতো নামকরা হাসপাতাল হয়। স্কয়ার হাসপতাালের অপচিকিৎসার প্রতিবাদ হওয়া উচিত, আর কত জীবন যাবে ওদের ভুল চিকিৎসায় প্রশ্ন করেন মৌরি।
এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার স্কয়ার হাসপাতালে ফোন করলেও কেউ ফোন ধরেননি।
সারাবাংলা/জেএ/এমএস