Tuesday 03 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভিডিও গেম বেপরোয়া করছে শিশু-কিশোরদের


৬ জুন ২০১৯ ১০:১৩ | আপডেট: ৬ জুন ২০১৯ ১০:৫২

ঢাকা: ১০ বছরের ইয়ামিন (ছদ্মনাম) পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ইয়ামিন বাসায় থাকলে মায়ের মোবাইল ফোনে গান শোনে, নাটক দেখে। কিন্তু যখন সে নানা বাড়ি বা দাদা বাড়ি বেড়াতে যায় তখন সে অন্য কারও ফোনে ভিডিও গেম ডাউনলোড করে খেলতে থাকে। আর এই খেলার ব্যস্ততায় তারা সারাদিন কেটে যায়। সম্প্রতি ইয়ামিনের আচরণে নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করে তার বাবা-মা। শান্ত ইয়ামিন এখন একটু কিছুতেই আগ্রাসী হয়ে ওঠে, বইপত্র ছুঁড়ে ফেলে, মায়ের সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করে, পরিবারের সঙ্গে কোথাও যেতে তার অনীহা, এমনকি ছোট দুই ভাই-বোনের গায়েও হাত তোলে সে। আর এসব অভিযোগ নিয়েই ইয়ামিনের বাবা-মা দারস্থ হয়েছেন চিকিৎসকের।  বাবা-মায়ের ধারণা, ভায়োলেন্সপূর্ণ ভিডিও গেম খেলেই লেখাপড়াতে মনোযোগী এবং গান শোনা ও গান গাওয়া শান্ত ছেলেটার এই পরিবর্তন।

বিজ্ঞাপন

গণমাধ্যকর্মী ঈহিতা জলিল দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ছেলের হাতে মোবাইল ফোন দেন। তার কিশোর সন্তান গান শেখে। তাই মোবাইলে সে গান শোনে ও নাটক দেখে। ঈহিতার ভাষায়, ‘যেহেতু ছেলেটা নিজেও গান শেখে, তাই ওইদিকেই তার আগ্রহ বেশি। কিন্তু সমস্যাটা তখনই হয় যখন দেখে অন্য বাচ্চারা গেম খেলছে’।

ঈহিতা বলেন, ‘আমার মত অনেকেই রয়েছেন যারা সন্তানকে একটা রুটিনে রাখতে পারি। কিন্তু যখনই মোবাইল আসক্ত অন্য বাচ্চাদের দেখে তখন তাকেও মোবাইল থেকে দূরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। ’

প্রথমে কোনো ধারণা না থাকলেও পরে দেখলাম, ছেলের ডাউনলোড করা বেশিরভাগ গেম মারামারিতে ভরা মন্তব্য করে ঈহিতা জলিল বলেন, ‘প্যারেন্টিং কোনো একক বিষয় না। সব বাবা-মা যদি সচেতন না হন তাহলে একা কোনো বাবা অথবা মায়ের পক্ষে এর সমাধান করা খুব কঠিন-যেটা আমি প্রতি পদে পদে ফেস করেছি’।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বর্তমানে মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট আসক্তি শিশু-কিশোরদের আচরণকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। তাদের চিন্তা ও আচরণকে বেপরোয়া করে তুলছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হবে। এই বিধ্বংসী পরিস্থিতি থেকে শিশু-কিশোরদের বের করে আনতে হবে। আর না পারলে আগামী প্রজন্ম নিয়ে আমাদের আশা করবার মত কিছু থাকবে না। শিশু-কিশোররা সামাজিক যোগাযোগ এবং সুস্থতার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই নতুন করে চিন্তার সময় এসেছে। সেটা আইন, সামাজিক উদ্যোগ বা নতুন কোনো কর্মসূচির মাধ্যমেও হতে পারে।’

দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণের পর সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভিডিও গেম আসক্তিকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আখ্যা দিয়ে একে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তারা নতুন এই রোগের নাম দিয়েছে গেমিং ‘ডিসঅর্ডার।’ আর এ বিষয়টি গেজেট আকারে প্রকাশ হবে ২০২০ সালের শেষে অথবা ২০২১ সালের শুরুর দিকে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বেশিরভাগ ভিডিও গেমের কনটেন্ট ভায়োলেন্স পূর্ণ। এই কনটেন্টের কারণেই তারা ভায়োলেন্স নিয়ে বড় হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের মনন। এমনকি তাদের আচরণেও বিধ্বংসী ভাব চলে আসে।’

কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘যেহেতু আমি শিশু কিশোরদের নিয়ে কাজ করি, তাই আমার কাছে কেবলমাত্র মোবাইল আসক্তি, গেম আসক্তি নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা মোট শিশুরোগীর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ। আর এর মধ্যে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী রোগীর সংখ্যাই বেশি।

কীভাবে এই আসক্তির কথা বোঝা যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা মোবাইলের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে। তাদের সামাজিকতা কমে যায়, বই পড়ে না, মুভি দেখে না। আর দিনে দিনে ভিডিও গেমে সময় কাটানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে এবং খেলতে না পারলে শারীরিক এবং মানসিক বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ’

তবে এ থেকে উত্তরণের জন্য মা বাবার সচেতনাতার দিকে বিশেষভাবে জোর দিয়ে তিনি বলেন, আমরা মোবাইল বা ইন্টারনেট বন্ধ করে প্রজন্ম তৈরি করতে পারব না। সেটা সম্ভবও না। তাই ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘র‌্যাশনাল’ হতে হবে, এবং এটা বাবা-মাকেই নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, সন্তানের হাতে মোবাইল তুলে দিয়ে যখন তারা অন্য কাজ করে তখন একে ‘ডিস্ট্রাকটেড প্যারেন্টিং’ বলা হয়।

ভিডিও গেমস চিন্তা ও আচরণ দুটোই পরিবর্তন আনে। মস্তিষ্কের যে সার্কিটে ইয়াবা ও গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক আসক্তি তৈরি করে ঠিক সেভাবেই ইন্টারনেটও সেখানে আসক্তি তৈরি করে বলে জানান ডা. হেলাল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও সমাজ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘মোবাইল ফোনে ভিডিও গেমের কারণে বর্তমানে মানুষের মধ্যে সামাজিক বিকলাঙ্গতা তৈরি হচ্ছে। তারা যোগাযোগে পিছিয়ে যাচ্ছে, অন্যের সঙ্গে মেশার ইচ্ছা বা প্রবণতা কমে যাচ্ছে, এমনকি আচরণেও হচ্ছে বিধ্বংসী। একইসঙ্গে শিশু-কিশোররা ওবেসিটিতে (স্থুলতা) আক্রান্ত হচ্ছে। নির্দিষ্ট একটা গণ্ডির মধ্যে সে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখছে। ফলে তার চিন্তা এবং কাজ করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশে রিক্রিয়েশনের টুলগুলোকে নির্দিষ্ট সেন্সরশিপের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। আমি কোন টুলগুলো কোন বয়সের শিশু-কিশোর জন্য ওপেন করব সে বিষয়ে রাষ্ট্র এবং সরকারকে কাজ করতে হবে। এর বাইরে পরিবার এবং বিদ্যালয়েরও ভুমিকা রয়েছে।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের (বেসিস) সাবেক সহ-সভাপতি রাসেল টি আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গণহারে কোনো কিছুর প্রতি হ্যাঁ বা না বলা কঠিন হবে। কারণ, পৃথিবীতে সবকিছুর ভালো এবং খারাপ দিক রয়েছে। কে কোনটা গ্রহণ করবে সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে। গেমের ভেতরে অনেক শিক্ষণীয় গেম রয়েছে, শিক্ষণীয় কন্টেন্ট রয়েছে। এখন কে কোনটা নেবে-এই লাইন ড্র করা প্রয়োজন। এছাড়া আইনটা ড্র করাও জরুরি। অনেক দেশই মোবাইলভিত্তিক লার্নিং নিয়ে এসেছে, সেখানে আমরা কিন্তু পিছিয়ে রয়েছি।

গুড প্র্যাকটিসের জায়গায় না গিয়ে যদি অনেক কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করি সেটাও কিন্তু ভালো না- মন্তব্য করে রাসেল টি আহমেদ বলেন, ‘যেসব দেশে গেম অ্যাডিকশন বেশি সেসব দেশেও ১৮ বছরের নিচের বয়সী শিশুদের জন্য কিছু নীতিমালা রয়েছে। আমাদের দেশের শিশুদের জন্যও ইন্টারনেট বিষয়ে একটি নীতিমালা থাকা জরুরি। ’

ইন্টারনেটের ভালো দিক অনেক বেশি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেটের খারাপ দিক কম। খারাপ কিছু জিনিস অনেক সময় সমাজ ধ্বংস করে এটাও সত্যি। তবে খারাপ বিষয়গুলোতে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। আবার এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে- পরবর্তী প্রজন্মের ইন্টারনেট লাগবে; এবং আমরা এখনও সেই জায়গাতে পৌঁছাইনি। বরং এই বিষয়ে শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। এই সচেতনতা বাবা-মা, শিক্ষক এবং সমাজ থেকেই শুরু করতে হবে। তখন ইন্টারনেটের খারাপ দিকগুলো এমনিতেই নিয়ন্ত্রণে আসবে।’

সারাবাংলা/জেএ/প্রমা

ভিডিও গেমস মোবাইলে

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর