ঈদে বাড়ি না গেলে কি হয়!
৬ জুন ২০১৯ ২২:২৪
ঢাকা: বছর ঘুরে আসা ঈদের আগেই বলতে গেলে রাজধানী ফাঁকা। ঢাকার স্থানীয়দের বাদ দিলে কর্মস্থল সূত্রে ঢাকায় ঢাকা সিংহভাগ মানুষই পাড়ি জমিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। তবু ফাঁকা হয়েও যেন ফাঁকা হয় না ঢাকা। কেউ কেউ থেকে যান ঈদেও। কেউ কেউ হয়তো টিকিট জটিলতায় আটকে পড়েন। একটু দেরিতে হলেও তারা রওনা দিতে যাচ্ছেন ঈদযাত্রা। কমলাপুর রেলস্টেশনের চিত্রও তাই বলছে, ঈদযাত্রার রেশ এখনো কাটেনি।
বৃহস্পতিবার (৬ জুন) কমলাপুর রেলস্টেশনে দেখা যায়, টিকিট কাউন্টারগুলোতে অপেক্ষারত মানুষের লাইন বেশ দীর্ঘ। দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের সবাই কমবেশি টিকেট পেয়ে যাচ্ছেন। আর তারপরই গিয়ে যোগ দিচ্ছেন স্টেশনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে গাট্টি-বোচকা নিয়ে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা আরও অনেক মানুষের সঙ্গে।
রেলস্টেশনে আসা প্রায় সবারই গন্তব্য বাড়ি। তাদের বড় একটি অংশই নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন শ্রেণির। কেউ দিনমজুর, কেউ রিকশাচালক, কেউ ভ্যানচালক, কেউ রঙমিস্ত্রি বা কেউ পোশাককর্মী। তাদের কেউ কেউ ঈদের দিনেও একটু ‘বাড়তি ইনকাম’ করে ফিরছেন গ্রামে,
কেউ তবে অনেকেই হয়তো ট্রেনের শিডিউল না জেনেই সকাল সকাল চলে এসেছেন স্টেশনে। তাই ট্রেন ছাড়তে ১৫/২০ মিনিটের বেশি দেরি না হলেও কাউকে কাউকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আবার প্রতিটি ট্রেনই কাঁটায় কাঁটায় সময় ধরে নয়, ওই কিছুটা দেরি করেই ছাড়বে বা স্টেশনে পৌঁছাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন সুমন মিয়া। সেখান থেকে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় মিলিয়ে মোট আট জনকে নিয়ে এসেছেন কমলাপুরে। গন্তব্য সুনামগঞ্জের মোহনগঞ্জে গ্রামের বাড়ি। ঈদের আগের ‘গাদাগাদি’তে টিকিট পাননি তারা। এদিকে ঈদে বাড়ি না গেলেই নয়! তাই এখন তারা কমলাপুর। হাওড়া এক্সপ্রেস ছাড়বে সেই রাত সাড়ে ১টায়। টিকিট পাবেন কি না— সেই দুশ্চিন্তায় দুপুর ১২টাতেই স্টেশনে এসে বসে আছেন। পেয়েছেন মিলেছে সবার টিকিটও। কিন্তু সময় গড়াতে গড়াতে ক্লান্ত হয়ে এখন ব্যাগে হেলান দিয়েই সময় কাটাচ্ছেন তারা।
ট্রেনের ‘ভেজালে’র জন্য ঈদের আগে গ্রামের বাড়ি যেতে পারেননি জামালপুরের সালেহা বেগম। জানালেন, প্রতি ঈদেই এমন হয়। নারায়ণগঞ্জের একটা ওয়ার্কশপে কাজ করা তার স্বামীর ছুটি হয়ে গেলেও ট্রেনের টিকিট পাওয়ার ঝামেলায় ঈদের পরদিন গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন তারা। পরিবারের সদস্য চার জন, কিন্তু টিকেট পেয়েছেন দু’জনের। সালেহা বলেন, ‘যে ভিড়ের ভয়ে ঈদের আগে গেলাম না, ঈদের পরদিন এসেও সেই ভিড় থেকে মুক্তি পাইলাম না।’
ঢালায় রিকশা চালান মোহাম্মদ শাজাহান শেখ। ঈদের আগে ভিড়ের ভয়ে বাড়ি যান না তারা। আবার ঈদের এই ক’দিন রিকশা চালিয়ে ইনকামও ভালো হয়েছে। এদিকে ঈদের সময় বাড়ি না গেলেই নয়। তাই ঈদের পরদিন স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন।
আকলিমা বেগম তার ননদ আর বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। টিকেট পেলেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ি যাবেন তারা। ঈদের আগে এই ভিড়ের ভয়ে যাননি। কিন্তু এখনও একই অবস্থা।
বাসের থেকে ট্রেনের ভাড়া কম— তাই সকাল ৯টা থেকে প্ল্যাটফর্মে এসে বসে আছেন ভ্যানগাড়ির চালক মমিন মিয়া। ঈদের আগে ট্রেনের টিকেট পাননি, তাই আজ সকাল সকাল ট্রেনের আশায় বসে আছেন তিনি। ঈদে বাড়ি যেতেই হবে।
চারপাশে ব্যাগ-বোচকা নিয়ে গোল হয়ে বসে আছেন তিন নারী। গন্তব্য রাজশাহী। তাদের পাশেই মেঝেতে ব্যাগে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে দুই শিশু। কথা হলো একজনের সঙ্গে। রুমানা বেগম জানালেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে সকাল ১০টার খানিকটা পরে এসে পৌঁছেছেন কমলাপুরে। অল্পের জন্য ১০টার ট্রেন মিস করেছেন। পরের ট্রেন রাত সাড়ে ১১টায়। সে পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে তাদের। খাওয়া বলতে প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনা কলা আর পাউরুটি।
রাজশাহীর যাত্রী মোহাম্মাদ আফসার হোসেন আর তার স্ত্রী সমতা গার্মেন্টসে কাজ করেন। জ্যামের ভয়ে ঈদের আগে বাড়ি যাননি। রাজশাহীর একটা ট্রেন ছাড়ে দুপুর ২টায়। ১টার দিকে স্টেশনে এসে জানতে পারেন, সেই ট্রেন বন্ধ। এখন রাত ১১টার ট্রেনের অপেক্ষায় প্ল্যাটফর্মেই শুয়ে আছেন সমতা বেগম। সমতা বলছিলেন, ‘আপা গো, যে কষ্টের ভয়ে ঈদের আগে গেলাম না বাড়ি, সেই কষ্ট আজকেও করতেছি। কিন্তু একমাত্র মেয়েটা বাড়িতে। ঈদে বাড়ি না গেলে কি হয়, বলেন?’
কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থাকা যাত্রীরা বলছেন, ঈদে ‘বাড়ি’ বা ‘দেশে’ যেতেই হবে, রাস্তায় যত কষ্টই হোক না কেন। সবার মুখেই এককথা— বাড়িতে মা-বাবা আত্মীয়স্বজন। ঈদ মানেই সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া। সেটুকু না হলে ঈদের আনন্দ পূর্ণতা পায় না। তাই বসে না পারলে দাঁড়িয়ে, ট্রেনের দরজা ধরে ঝুলে কিংবা ট্রেনের ছাদে উঠে হলেও গ্রামের বাড়ির পথে যাত্রা করছেন তারা।
এই যে ঈদের আগে, ঈদের দিন বা ঈদ চলে গেলেও গ্রামের বাড়ি যাওয়ার যে তাড়না, সেটা কেন? এ প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. এম সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ, তথা গোটা উপমাহাদেশের মানুষের মধ্যে আবহমান কাল থেকেই সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকার প্রবণতা কাজ করে আসছে। আর এর সূত্র ধরে মানুষের এই যে ‘নাড়ির টানে’ বা ‘শেকড়ের টানে’ বাড়ি ছুটে যাওয়া, এই বিষয়টিকে দুইটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় বলে মত তার।
সাইফুল ইসলাম বলেন, নগরায়নের ফলে আমাদের কর্মক্ষেত্রগুলো শহর এলাকাতেই বিস্তার পেয়েছে বেশি। তাই গ্রামের মানুষ শ্রেণি নির্বিশেষে শহরে এসে ভিড় করেছে চাকরির সুবিধার জন্য। এই মানুষগুলোই ঈদ বা অন্য উৎসবে গ্রামের উদ্দেশ্যে ছুটে যায়, যত ভোগান্তিই হোক না কেন।
এই আচরণের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকও রয়েছে বলে মনে করেন উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, এই উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে পারিবারিক টানের বিষয়টি ছোটবেলা থেকেই সচেতনভাবে গড়ে তোলা হয়। উপমাহাদেশের মা-বাবারা ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের কালেকটিভ আচরণ বা সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলতে শেখান। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বে বা উন্নত দেশগুলোতে ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক আচরণ বা একা চলতে শেখানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এই কারণে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে পরিবার ও সমাজের সবার প্রতি টান তৈরি হয়। সেই টানেই মানুষ ঈদ কিংবা অন্যান্য উৎসবের ছুটিতে সব ঝামেলা উপেক্ষা করে গ্রামের উদ্দেশ্যে ছুটে যায়।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর