Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হারিয়ে ফেলা ‘সেলুলয়েডের কবি’র জন্মদিন আজ


৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ১২:০৬

সারাবাংলা ডেস্ক

স্বপ্নবাজ এক ছবির ফেরিওয়ালা, জীবনের হাজারো রং আর দৃশ্যগুলোকে সেলুলয়েডে বন্দি করতে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। বহমান জীবনের কবিতাগুলো যার সেলুলয়েডে হয়ে উঠেছিল মূর্ত— সেই ‘সেলুলয়েডের কবি’ তারেক মাসুদের জন্মদিন আজ।

সমসাময়িকদের কাছে তিনি শুধু সিনেমার কারিগর ছিলেন না।  ছিলেন সিনেমার ফেরিওয়ালাও।  আমাদের মুক্তির সংগ্রামের গল্প থেকে সাধারণ মানুষের জীবনযুদ্ধ সবই উঠে এসেছে তাঁর দৃশ্যায়িত সিনেমার পরতে পরতে।  আমাদের দুর্ভাগ্য বড় অসময়ে হারিয়েছি তাঁকে।

চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের পুরো নাম আবু তারেক মাসুদ।  ১৯৫৭ সালের আজকের দিনে ফরিদপুরের ভাঙ্গার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।  মায়ের নাম নূরুন নাহার, বাবার নাম মশিউর রহমান মাসুদ।

ভাঙ্গা উপজেলার ঈদগাঁ মাদ্রাসায় প্রথম পড়াশোনা শুরু করেন তারেক মাসুদ। এরপর ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা শেষ করেন তিনি।  পরে ভাঙ্গা পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন।  ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তার পড়াশোনায় ছেদ পড়ে।  তবে এরপর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ছয় মাস পড়াশোনার পর বদলি হয়ে নটরডেম কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করেন ।

তারেক মাসুদ এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। মূলত এ সময় থেকেই তিনি  চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন।  তিনিই এ দেশের পরিচালকদের মধ্যে প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের সূচনা করেন।  আরেক কিংবদন্তী মেধাবী নির্মাতা আলমগীর কবির ছিলেন তাঁর সিনেমাগুরু।  লেখক আহমদ ছফার বিশেষ ভক্ত ছিলেন তিনি।

আমরা তাকে চিনি বিকল্পধারার চলচ্চিত্রকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ফেরিওয়ালা হিসেবে।  তারেক মাসুদ ছিলেন একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক ও গীতিকার।

১৯৮২ সালের শেষ দিকে নির্মাতা হিসেবে তারেক মাসুদের যাত্রা শুরু। এ সময় তিনি প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন।  ১৯৮৯ সালে মুক্তি পায় ওই  প্রামাণ্যচিত্রটি।  এর আগে ১৯৮৭ সালে সোনার বেড়ি নামে নির্যাতিত নারীদের ওপর ২৫ মিনিট স্থায়িত্বের একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেছিলেন তিনি।

মেধাবী নির্মাতা তারেক বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র, এনিমেশন, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন।  ২০০২ সালে তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মাটির ময়না মুক্তি পায়। মাটির ময়নার জন্য তিনি ২০০২-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টর ফোর্টনাইটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। মাটির ময়না বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে, সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের জন্য একাডেমি পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিল।

তার সর্বশেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র রানওয়ে মুক্তি পায় ২০১০ সালে। তারেক মাসুদের অপর চলচ্চিত্রগুলো হলো অন্তর্যাত্রা (২০০৬) ও নরসুন্দর (২০০৯)।  তিনি ১৯৯৫ সালে স্ত্রী ক্যাথরিনে সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণ করেন তথ্যচিত্র মুক্তির গান।

তারেক মাসুদ বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।  দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্রবিষয়ক অসংখ্য কর্মশালা এবং কোর্সে অংশ নিয়েছেন তিনি।  বাংলাদেশের বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সংগঠন শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি।  ১৯৮৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেছেন।

তিনি স্ত্রী ক্যাথরিনকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, যার নাম অডিওভিশন।  এই দম্পতির বিংহাম পুত্রা মাসুদ নিশাদ নামে এক ছেলে আছে।

তারেক মাসুদ আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।  তার বেশির ভাগ চলচ্চিত্র কেবল কাহিনী-কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এগুলোর মধ্যে সমকালীন সমাজব্যবস্থার নানা প্রসঙ্গ যেমন মানবজীবন, লোকসংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি, রাষ্ট্র, জগৎ প্রভৃতি সম্পর্কে তাঁর ভাবনাও স্থান করে নিত।

স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো তারেক মাসুদ। চলচ্চিত্রকে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে দাঁড় করতে চেয়েছিলেন তিনি।  তিনি চেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা।  কিন্তু তিনি তা করে যেতে পারেননি।  কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট তার স্বপ্নের সিনেমা ‘কাগজের ফুল’ সিনেমার শুটিংস্পট নির্বাচন করে ফেরার পথে মানিকগঞ্জের ঘিওরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন।

তারেক মাসুদ মাত্র কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।  কিন্তু যে কয়টা নির্মাণ করেছেন সেখানে নিজের বক্তব্যকে তুলে ধরেছেন নির্ভয়ে।  দৃষ্টি শক্তিকে নিয়ে গেছেন মানব মনের অতল তলে।  দেখাতে চেয়েছেন মানব মনের গভীরের যাতনা, মর্মবেদনা, ক্রন্দন, জিজ্ঞাসা, ঘৃণা।  সৃষ্টি করতে চেয়েছেন চলচ্চিত্রের কাব্যিক ঢং।  যার জন্য আমরা এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছি।  তারেক মাসুদ দর্শকের মনে প্রশ্ন তৈরি করেছেন, দ্বিধায় ফেলেছেন, করেছেন আত্মসচেতন।  যাদুকরের মতো সমাজ বাস্তবতায় নিয়ে গেছেন দর্শকদের।  চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন জীবনের নির্মম সত্যকে।

মৃত্যুর পর ২০১২ সালে তারেক মাসুদকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক প্রদান করা হয়।

সারাবাংলা/এসবি/আইজেকে

 

 


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার শাজাহান খান
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০২:৪৫

সম্পর্কিত খবর