সাপ পুষছে বাংলাদেশ
১৮ জুন ২০১৯ ১১:৫৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বাংলাদেশে প্রতি বছরই সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন বহু মানুষ। এদের মধ্যে মারাও যান অনেকে। অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হলেও তা শেষ পর্যন্ত কাজ করে না। ফলে তার মৃত্যু হয়। দেশে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসায় যে প্রতিষেধক ব্যবহার করা হয় সেগুলো মূলত ভারতে তৈরি। সেখানকার সাপের বিষ থেকেই তৈরি হয় এসব প্রতিষেধক।
কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তাদের গবেষণায় দেখেছে, অঞ্চলভিত্তিক সাপের বিষের মধ্যে তারতম্য থাকে। এজন্য যে অঞ্চলের সাপ মানুষকে দংশন করে, তাদের চিকিৎসায় সেই অঞ্চলের সাপের বিষ দিয়ে প্রতিষেধক তৈরির উপর জোর দিচ্ছে সংস্থাটি।
তাই বাংলাদেশে সাপে কাটা রোগীদের প্রাণরক্ষায় দেশেই প্রতিষেধক তৈরির প্রকল্প হাতে নেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় শুরু পাঁচ বছর মেয়াদি এই অ্যান্টিভেনম তৈরির প্রকল্প। এ জন্য দেশীয় প্রজাতির বিষধর সাপ থেকে বিষ সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর এই কাজ চলছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক)। মেডিসিন বিভাগ এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিষ সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির সাপ সংগ্রহ করা হয়েছে। চমেক হাসপাতালের পুরনো একাডেমিক ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে বিষধর এসব সাপের নিরাপদ আবাসস্থল। ইতোমধ্যে চার প্রজাতির বিষধর সাপ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ভেনম। গবেষণাগারে রেখে সেই ভেনমের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সারাবিশ্বে সাপে কাটাকে বিশ্বের অবহেলাজনিত অন্যতম রোগ হিসেবে বিবেচনা করছে। সাপে কাটার ফলে মৃত্যুকে বিশ্বের অন্যতম অবহেলাজনিত মৃত্যু হিসেবে বিবেচনা করছে। সংস্থাটি বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার বিষয়ে মত দেয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চমেকের মাধ্যমে সাপের বিষের প্রতিষেধক তৈরির এই কার্যক্রম শুরু করেছে।
প্রকল্পের মুখ্য গবেষকের দায়িত্বে আছেন চমেকের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন হচ্ছে- অঞ্চলভিত্তিক সাপ সংগ্রহ করে সেই সাপের ভেনম নিয়ে গবেষণা করতে হবে। তারপর সেই ভেনম থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি করতে হবে। এই গাইডলাইন অনুযায়ী আমরা একবছর আগে প্রকল্পের কাজ শুরু করেছি। সাপ সংগ্রহ করেছি। বাচ্চাসহ আমাদের কাছে এখন ৬১টি সাপ আছে। সাপের কিছু ভেনমও আমরা ইতোমধ্যে সংগ্রহ করেছি। সেগুলোর উপর গবেষণা চলছে।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘অঞ্চলভেদে মানুষের চেহারা এক হতে পারে, সাপের প্রজাতিও এক হতে পারে। কিন্তু সাপের বিষ কখনো এক হয় না। এজন্য বিদেশ থেকে যেসব অ্যান্টিভেনম আনা হয়, তা বাংলাদেশে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসায় অনেকক্ষেত্রে কার্যকর হয় না। এসব অ্যান্টিভেনম ব্যবহারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয়। এখন দেশীয় সাপ থেকে ভেনম নিয়ে যদি অ্যান্টিভেনম তৈরি করা যায়, তাহলে আমাদের সাপে কাটা রোগীদের জন্য খুবই উপকার হবে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে ভারতের পাঁচ প্রজাতির বিষধর সাপ থেকে তৈরি অ্যান্টিভেনম আমদানি করা হয়। এর মধ্যে চার প্রজাতির সাপ বাংলাদেশেই আছে। গবেষণায় বের করা হবে ভারতের সাপের সঙ্গে বাংলাদেশের সাপের বিষের তারতম্য।
আট কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চমেকের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্স মেন্টর ট্রপিক্যাল মেডিসিন, মেডিসিন টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং জার্মানির গ্যোটে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা।
২০১৮ সালের মার্চে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ সংগ্রহ শুরু করা হয়। বর্তমানে চার প্রজাতির ১৮টি পূর্ণ বয়স্ক সাপ এখানে রয়েছে। এর মধ্যে দুই প্রজাতির ১০টি গোখরা, কেউটে প্রজাতির একটি কালকেউটে ও দুটি শঙ্খিনী এবং ভাইপার প্রজাতির তিনটি সবুজ বোড়া সাপ আছে।
সাপের বাচ্চা আছে ৪৩টি। এর মধ্যে খইয়া গোখরার (ফুলগোখরা) বাচ্চা আছে ১টি। পদ্মগোখরার বাচ্চা আছে ৩৩টি। ভাইপার প্রজাতির সবুজ বোড়া সাপের বাচ্চা আছে ৯টি। খইয়া গোখরা ও পদ্মগোখরার ডিম থেকে বাচ্চা জন্ম নিয়েছে কমপক্ষে তিনমাস আগে। আর সবুজ বোড়ার ৯টি বাচ্চা হয়েছে গত ৫ জুন।
চমেকের পুরনো একাডেমিক ভবনে একটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে রাখা হয়েছে এসব বিষধর সাপ ও বাচ্চাগুলোকে। এই কক্ষের পাশে আরেকটি কক্ষ হচ্ছে ইঁদুরের প্রজনন কক্ষ। সাপের খাবার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে এই ইঁদুর। এছাড়া নির্বিষ ডোরা সাপও দেওয়া হচ্ছে বিষধর সাপগুলোর খাবার হিসেবে।
প্রকল্পের কাজে যুক্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করা মো.মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে জানান, গত মে মাসে সংরক্ষণ করা বিষধর সাপগুলো থেকে ভেনম সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে সাপগুলো থেকে খুবই কম পরিমাণে ভেনম পাওয়া গেছে। কোনো সাপ থেকেই ভেনম সংগ্রহের পরিমাণ এক মিলিমিটার পর্যন্ত পৌঁছায়নি।
‘ভেনম প্রদান সাধারণত নির্ভর করে সাপের মুড, আবহাওয়া, পরিবেশ এবং খাবারের উপর। এবার আমরা খুবই কম পরিমাণে ভেনম পেয়েছি। তবে যা পেয়েছি, তা দিয়েই গবেষণা শুরু হয়েছে।’
মিজানুর বলেন, ‘সংগ্রহ করা ভেনমের মধ্যে কি কি প্রপার্টিজ আছে সেটা নিয়ে গবেষণা চলছে। ভারতের সাপের বিষের প্রপার্টিজের সঙ্গে সেগুলো মেলানো হবে। কমপক্ষে তিনবছর লাগবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে। এরপর অ্যান্টিভেনমের স্যাম্পল তৈরি করে বিভিন্ন প্রাণীর উপর প্রয়োগ করে এর কার্যকারিতা যাচাই করা হবে। এক্ষেত্রে যেসব সীমাবদ্ধতা পাওয়া যাবে সেগুলো চিহ্নিত করা হবে। সেগুলো নিরসন করে চূড়ান্তভাবে অ্যান্টিভেনমের স্যাম্পল তৈরি করে পাঠানো হবে জার্মানিতে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ল্যাবে।’
তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার চূড়ান্ত অনুমোদন ছাড়া এই অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের উপযোগী হবে না জানিয়ে মিজানুর বলেন, ‘বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি নিয়মিত এসে প্রকল্পের কাজ পরীক্ষা করছেন। তারা যদি মনে করেন, আমরা সংস্থাটির গাইডলাইন মেনে অ্যান্টিভেনম তৈরি করেছি, তাহলে অনুমোদন দেবে। না হলে, আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো কোথায়, সেটা তারা চিহ্নিত করে দেবে। সেই অনুযায়ী আবার আমাদের কাজ করতে হবে।’
চূড়ান্তভাবে অ্যান্টিভেনম তৈরিতে আরও কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন মিজানুর রহমান।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রায় ৩০ প্রজাতির সাপ আছে। এর মধ্যে স্থলভাগে প্রায় ১৫ প্রজাতির বিষধর সাপের বিচরণ আছে। বাকিগুলো সামুদ্রিক প্রজাতির সাপ। স্থলভাগে বিচরণ আছে এমন সাপের মধ্যে আছে, তিন প্রজাতির কোবরা, পাঁচ প্রজাতির কেউটে এবং ছয় প্রজাতির ভাইপার (সবুজ বোড়া ও চন্দ্রবোড়া)। এছাড়া বাংলাদেশে সাগরে বিদ্যমান দুই প্রজাতির কোরাল স্নেক বা প্রবাল সাপ আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে প্রায় এক লাখ মানুষকে বিষধর সাপ দংশন করে। এর মধ্যে ৬ হাজার লোক সাপের কামড়ে মারা যায়। দংশনের পর রোগীর শরীরের রক্তকে দূষিত করে, মাংসপেশিকে অকার্যকর করে এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নষ্ট করে সাপের বিষ মানুষের মৃত্যু ঘটায়।
সারাবাংলা/আরডি/এসএমএন