জাকিয়া আহমেদ,স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: ৩০ তম বিসিএসের কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। গত ১৭ জানুয়ারি স্কয়ার হাসপাতালে পিত্তথলির পাথর অপসারণ করতে গিয়ে চিকিৎসক তার ডিওডেনাম (পাকস্থলীর ঠিক নিচের ক্ষুদ্রান্তের প্রথম অংশ) ছিদ্র করে দেন। আর এ থেকেই নজরুল ইসলামের পুরো শরীরে ইনফেকশন হয়ে যায়, আক্রান্ত হন জন্ডিসে। পরে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু সেখানেও ডিওডেনাম ক্ষত নিয়ে চিকিৎসকরা কিছু করতে না পারায় তাকে গতকাল রাতে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়।
নজরুল ইসলামের স্ত্রী সারাফ আনিকা হক মৌরি সারাবাংলাকে বলেন, স্কয়ার কর্তৃপক্ষ কেবল তার স্বামীর ভুল চিকিৎসাই করেনি, তা নিয়ে মিথ্যাচার যেমন করেছে, তেমনি তথ্য গোপন করে অযথা সময় ক্ষেপণ করেছে। ফলে নজরুল ইসলামের অবস্থা এখন শঙ্কটাপন্ন। মৌরি জানান, স্কয়ার কর্তৃপক্ষ কেবল ভুল চিকিৎসা দিয়ে তথ্য গোপন করেছে তাই নয়। অস্ত্রোপচারের সময়ে ভিডিও হওয়া সিডিও দেওয়া হয়নি তাদেরকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক সারাবাংলাকে নিজের অভিজ্ঞতার কথাও বলেন। তিনি বলেন, আমি এমন একটা ভুল করেছিলাম, কিন্তু সেটা আমি লুকাইনি। রোগীর কাছে স্বীকার করি এবং ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হই। রোগীর স্বজন মেনে নেয় এবং আমাকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধা দেয়।
এই চিকিৎসক বলেন, আমাদের দেশের মানুষ সত্যকে মেনে নেয় বলেই আমার ধারণা। আর দেশের সাধারণ মানুষ এখনও চিকিৎসকদের দেবতাজ্ঞান করেন। অথচ আমরা ভুলভাল আচরণ করি তাদের সঙ্গে।
চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলা, ভুল চিকিৎসা বা গাফিলতির অভিযোগ আনার একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। এখানে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ জানাতে পারে, অভিযোগ আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে তারা তদন্ত করে, অভিযোগ প্রমানিত হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয় বিএমডিসি। তবে ভুক্তভোগীকে কোনও আর্থিক সহায়তা করার ক্ষমতা বিএমডিসির নেই, সেক্ষেত্রে তাকে আদালতের কাছে যেতে হবে।
বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সারাবাংলাকে বলেন, একজন চিকিৎসকের কোনও এখতিয়ারই নেই রোগীর তথ্য তাদের কাছে গোপন করার, এটা চিকিৎসা পেশাতেই পড়ে না। তিনি বলেন, রোগী যদি (কম্প্লিট ম্যান) অচেতন এবং শিশু না হন বা তাকে বলার মতো অবস্থায় থাকেন, তাহলে সব ধরনের তথ্য জানার অধিকার তার রয়েছে। আর যদি সেটা না হয়, তাহলে রোগী স্বজনকে রোগীর সামনে রেখে সব জানাতে হবে-এটাই নিয়ম এবং এর ব্যত্যয় হবার কোনও সুযোগ নেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে।
একইসঙ্গে অধ্যাপক রশীদ-ই মাহবুব বলেন, তবে এখানে চিকিৎসকের সক্ষমতাও দেখতে হবে। দেখতে হবে, এই চিকিৎসক এ ধরণের অপারেশনের জন্য সঠিক ব্যক্তি কীনা। এমনকী, সে যদি এধরণের অপারেশন প্রথম করে থাকেন, সেটাও তাকে রোগীকে বলতে হবে এবং রোগীর কাছ থেকে সম্মতি নিতে হবে।
চিকিৎসকদের কোনও ভুলের কারণে রোগীর ভোগান্তি হলে তার পুরো দায় চিকিৎসক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তথ্য গোপনের কারনে নজরুল ইসলাম এবং তার পরিবারের যে ভোগান্তি হলো তাতে করে এই চিকিৎসক এবং পুরো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর্থিক ভাবে তাদেরকে দিতে বাধ্য থাকবে এবং এটা রোগীর প্রাপ্য’।
এখানে বিএমডিসির ভুমিকা কী জানতে চাইলে অধ্যাপক রশীদ-ই মাহবুব বলেন, রোগীর কাছে এই চিকিৎসক কেন তথ্য গোপন করেছে সে বিষয়ে বিএমডিসিকে তদন্ত করতে হবে।একইসঙ্গে বিএমডিসিতে বলা হয়েছে, ‘কনসেন্টমেন্টস অব ফ্যক্টস’ রুলস অনুযায়ী, তথ্য গোপনের অভিযোগে চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন বাতিল হবার কথা-বলেন অধ্যাপক রশীদ।
ঠিক ‘তথ্য গোপন’ নিয়ে বিএমডিসি আইনে কিছু বলা না হলেও তথ্য গোপন-ভুল চিকিৎসার একটি অংশ-সারাবাংলাকে বলেন বিএমডিসির রেজিস্ট্রার ডা. জাহেদুল হক বসুনিয়া। তথ্য দিয়ে চিকিৎসা করা পার্ট অব দ্যা ট্রিটমেন্ট-যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ট্রিটমেন্ট পয়েন্ট অব ভিউ’ থেকে কোনও চিকিৎসক রোগীর তথ্য গোপন করতে পারে না। কোনও ভয়ের বিষয় হলেও রোগীকে না জানাতে পারলে তার পরিবারকে অবশ্যই জানাতে হবে এবং এটাই হওয়া উচিত।
ডা. জাহেদুল হক বসুনিয়া বলেন, গ্রাভিটি অব দ্যা ট্রিটমেন্ট, গ্রাভিটি অব দ্যা ক্রাইমের ওপর শাস্তির বিধান রয়েছে বিএমডিসিতে। এসব বিবেচনা করে প্রথমে সাময়িকভাবে রেজিস্ট্রেশন বাতিল, পরে সবকিছু দেখে, তদন্ত করে যদি সত্যতা পাওয়া যায় তখন স্থায়ীভাবে রেজিস্ট্রেশন বাতিলের বিধান আছে জানিয়ে তিনি বলেন ,ইট ডিপেন্ডস অন দ্যা ক্রাইম অ্যান্ড রং ট্রিটমেন্ট।
সারাবংলা/জেএ/জেডএফ