Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘নদী আমার দুইডা মানিকরে কাইড়া নিলো’


২১ জুন ২০১৯ ১৬:১২

ঢাকা:  ‘স্কুলের ম্যাডামরা কইতো আপনার মাইয়্যা খুবই চঞ্চল। পড়ালেখা ভালো করবো। ওর দিকে মনোযোগ দিয়েন। আমি ওরে খুব আদর করতাম। পরীর মতন মাইয়্যাডা আমারে বাবা কই তো কম, পোলা ডাকতো আমারে। আমি ওরে মা ডাকতাম। আমার মারে আমি কই পামু এখন! ছেলেটাকেও মাদ্রাসার সবাই আদর করতো। নদী আমার দুইডা মানিকরে কাইড়া নিলো…!’

শুক্রবার (২১ জুন) সকাল পৌনে ৭ টার দিকে সদরঘাট এলাকায় নৌকাডুবির ঘটনায় দুই ভাইবোনের মৃত্যুতে এভাবে বিলাপ করেন তাদের বাবা গার্মেন্টস ব্যবসায়ী বাবুল ফরাজী।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার (২১ জুন) সকাল পৌনে সাতটার দিকে বরিশাল থেকে ঈদের ছুটি কাটিয়ে নয় মাসের কোলের শিশু নুসাইবাকে নিয়ে কেরানীগঞ্জের ভাড়া বাসায় ফিরছিলেন তার স্ত্রী জোসনা, ছেলে মেশকাত (১২) মেয়ে নুসরাত (৫) এবং স্ত্রীর আপন ভাই শামীমসহ ৫ জন। সদরঘাটের ওয়েজঘাট থেকে কেরানীগঞ্জ যাওয়ার জন্য ছোট্ট ডিঙি নৌকায় উঠেছিলেন তারা। এ সময় যাত্রী নামিয়ে নৌকার পাশ দিয়ে কেরানীগঞ্জ যাচ্ছিল এমভি পূবালী-৫। এ সময় লঞ্চটির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নৌকাটি ডুবে যায় বলে ধারণা স্থানীয়দের। ঘটনার সময় শিশু নুসাইবা তার মামা শামীমের কোলে থাকায় শিশুটিসহ তার মা সাঁতরে তীরে পৌঁছায়। কিন্তু তাদের সঙ্গে থাকা অপর দুই শিশু নুসরাত ও মেশকাতকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

নৌকা ডু্বিতে দুই শিশু নিখোঁজের খবর পেয়ে তাদেরকে উদ্ধারে নদীতে অভিযান চালায় যৌথভাবে ফায়ার সার্ভিস, নেভী, কোস্টগার্ড এবং নৌ পুলিশ। প্রায় ৫ ঘন্টার অভিযান শেষে দুপুর বারোটার দিকে শিশু দুটিকে মৃত উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল।

শিশুদের বাবা বাবুল সারাবাংলাকে বলেন, ঈদের আগে ওরা গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিল। শনিবার থেকে ওদের স্কুল মাদ্রাসার ক্লাস শুরু হবে। তাই বৃহস্পতিবার রাতে ওরা তিন ভাইবোনসহ ওদের মা লঞ্চে করে বরিশালের বাকেরগঞ্জের উত্তমপুর গ্রাম থেকে সদরঘাট সকালে আসছিল। এরপর ওদের মামা ওদেরকে নিয়া কেরানীগঞ্জের শান্তপাড়া এলাকায় যাওয়ার জন্য ওয়েজঘাট থেকে ডিঙি নৌকা করে যাচ্ছিল। মানিক দুইডারে খুঁইজা পাইছে কিন্তু ওরা তো কথা বলে না মোর লগে। মুই কির পিন্নে (কি করে) থাকমু ওদের ছাড়া!

বিজ্ঞাপন

ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ জামান সারাবাংলাকে বলেন, খবর পেয়ে ফায়ারের ২০ সদস্যের দুটি ডুবরি দল উদ্ধার কাজ শুরু করে। এসময় কোস্টগার্ড, নেভী ও নৌ-পুলিশও উদ্ধার কাজে সহায়তা করে। প্রায় ৫ ঘন্টা পর শিশু দুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মিডফোর্ট হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। তবে কিভাবে নৌকা ডুবেছিল তার সঠিক কোনো কারণ তিনি জানাতে পারেন নি।

এমনকি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা প্রশাসনিক কোনো কর্মকর্তাই সঠিক কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না বলে জানান। প্রাথমিকভাবে সকলে মনে করেছিলেন নৌকা চালকের অদক্ষতার কারণেই এমনটা হয়েছে।

সদরঘাট নৌ-পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ রেজাউল সারাবাংলাকে বলেন, কি কারণে নৌকা ডুবেছে তার সঠিক কারণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে মনে হচ্ছে চালকের অদক্ষতার কারণেই নৌকা ডুবেছিল। আর শিশু দুটি যেহেতু সাঁতার জানে না তাই নৌকা ডোবার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো তারা তলিয়ে গিয়েছিল স্রোতের সঙ্গে।

কিন্তু নদীর বিপরীত পাশে অর্থাৎ সদরঘাটের উল্টো পাড়ের স্থানীয় ডিঙি বা ছোট নৌকা চালকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের অনেকেই নৌকা ডুবির ঘটনার সময় ওই পাড় থেকে প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন। তাদের একজন মিনু মাঝি। যিনি নিজেও নৌকা ডুবির ঘটনায় নিখোঁজ শিশুদের খুঁজতে নদীতে নৌকা নিয়ে ছুটোছুটি করেছিলেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ওরা যখন এপারের দিকে আইতেছিল ঠিক তখনি পাশের পূবালী-৫ লঞ্চটা পিছনে আসার জন্য ইঞ্জিন স্টার্ট (চালু) দেয়। এসময় ইঞ্জিন ঘুরার কারণে বড় বড় ঢেউয়ের চাপে লঞ্চটার সঙ্গে ধাক্কা খায়। ধাক্কা খেয়েই নৌকাটি কাত হয়ে ডুবে যায়। এরপর তো আমরাও ছুটোছুটি করে দ্রুত নৌকা নিয়ে ওদের তিনজনকে পাড়ে আনি। কিন্তু ওই দুইটা বাচ্চা তো ছোট, তাই তারা সাঁতার না জানায় আমরা যেতে যেতে তলিয়ে যায়।

এসময় অপর একজন স্থানীয় মাঝি রফিক মুন্সি বলেন, কয়েকমাস পর পর এমন ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয় না। আমরা বারবার দাবি জানিয়েছি যে, আমাদের (ছোট নৌকা) এবং লঞ্চ চলাচলের জন্য যেন আলাদা জায়গা করে দেয়। তাহলে কেউ কারো পথে যাবে না আর এমন ঘটনাও ঘটবে না।

এ বিষয়ে কথা বলতে ঢাকা-পটুয়াখালীগামী পূবালী-৫ নামের ওই লঞ্চে গিয়ে দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায় নি। লঞ্চে থাকা একজন কর্মচারী সিরাজ সারাবাংলাকে বলেন, আমরা সকালে পটুয়াখালী থেকে সদরঘাট এসে যাত্রী নামিয়ে কেরানীগঞ্জের ওই পাড়ে লঞ্চটা ভিড়ানোর জন্য যাচ্ছিলাম। কিন্তু এসময় নাকি একটা নৌকা আমাদের লঞ্চের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে গেছে। কিন্তু এটা তো আর আমরা ইচ্ছা করে করতে পারি না। নৌকার মাঝি নিজে যখন দেখলো লঞ্চটি বের হবে তখন কি তার উচিত ছিল না সতর্ক হওয়া। এখন দোষটা সবাই লঞ্চের দিচ্ছে। মাঝির দোষ কেউ দেখছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডোর মাহবুব-উল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, নৌকা ডুবির ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীদের একেকজন একেক কথা বলছে। কেউ বলছে লঞ্চের ঢেউয়ের ধাক্কায় আবার কেউ বলছে লঞ্চটির ধাক্কায় নৌকাটি ডুবেছিল। তাই এর সঠিক কারণ অনুসন্ধান না হওয়া পর্যন্ত পূবালী-৫ লঞ্চটি আটক থাকবে। সেই সঙ্গে যে নৌকাটি ডুবে গেছে ওই নৌকার মাঝিকে ঘটনার পর থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য তাকেও খুঁজে বের করে তারপর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ শুধু লঞ্চের দোষ ছিল বলে যে কথা সবাই বলছে তা নাও হতে পারে। কারণ এখানে যারা ছোট নৌকা চালায় তাদের অধিকাংশই অদক্ষ। এটাও দুর্ঘটনার একটা বড় কারণ।

তিনি আরও বলেন, আমরা বার বার চেষ্টা করেছি ছোট ছোট নৌকাগুলো এখানে চলাচল বন্ধ করতে। কিন্তু স্থানীয়দের সদিচ্ছার অভাবে তা পারছি না। তাই এটা বন্ধ করতে স্থানীয়দের সহযোগীতার আহ্বান জানান তিনি। সেই সঙ্গে ঘটনার তদন্ত শেষে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ দোষী হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলেও জানান তিনি।

সারাবাংলা/এসএইচ/জেএএম

নৌকাডুবি পূবালী-৫

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর