হবে না আইয়ুব বাচ্চু চত্বর, বসবে শুধু রূপালী গিটার
২১ জুন ২০১৯ ২০:৩৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত চট্টগ্রাম শহরের প্রবর্তক মোড়ের নাম বদলে ‘আইয়ুব বাচ্চু চত্বর’ করার ঘোষণা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। তবে চসিকের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রবর্তক মোড়ের নাম পাল্টানোর কোনো সিদ্ধান্ত তাদের নেই। মোড়ে শুধু আইয়ুব বাচ্চুর রূপালী গিটার স্থাপনের মাধ্যমে ‘ইয়ং এনভায়রনমেন্ট’ তৈরি করা হবে।
চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউট হল ভেঙ্গে যে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে সেটি আইয়ূব বাচ্চুর নামে করার প্রাথমিক ঘোষণাও এসেছিল। তবে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম হলের নাম পরিবর্তন নিয়ে সমালোচনার মুখে সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যেতে হয় চসিকের।
এরপর সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্থায়ী কমিটি ও মাসিক সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনের চলমান কার্যক্রমের আওতায় ব্যস্ত এলাকা প্রবর্তক মোড়ে স্থাপন করা হবে বাচ্চুর রূপালী গিটার। সেই মোড়কে আইয়ুব বাচ্চু চত্বর হিসেবে গড়ে তোলা হবে বলেও সিটি করপোরেশনের বরাতে খবর এসেছে গণমাধ্যমে। সিটি করেপারেশনের প্রণীত নকশায়ও লেখা আছে ‘আইয়ুব বাচ্চু চত্বর’।
এর সমালোচনা করে নগরীর সৌন্দর্য্যবর্ধনে যুক্ত চারূশিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য্য ফেসবুকে লেখেন, ‘আইয়ুব বাচ্চুর শুধু রূপালী গিটার কেন? কেন শ্রদ্ধেয় শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের পূর্ণাঙ্গ স্ট্যাচু নয় ? আর একজনকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে, স্মৃতিময় করে রাখতে গিয়ে, একটি ঐতিহ্যময় জায়গার নাম পরিবর্তন করতে হবে কেন ? আমাদের সম্মানীতদের সাম্প্রদায়িক ভয়ঙ্কর চেহারা মাঝে মাঝে মুখোশ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ফজলে এলাহী লিখেছেন, ‘প্রবর্তক মোড়ের নাম কেন পাল্টাতে হবে? ওই মোড়ের নাম প্রবর্তক মোড় রেখেও ওখানে আইয়ুব বাচ্চুর স্ট্যাচু ও রূপালী গিটারের ভাস্কর্য হতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, প্রবর্তক মোড় চট্টগ্রাম শহরের ইতিহাসেরই অংশ।’
ফেসবুকজুড়ে এই ধরনের সমালোচনামূলক অংসখ্য স্ট্যাটাস এবং এর সঙ্গে মন্তব্যের বিষয় নিয়ে বক্তব্য জানতে চাওয়া হয় চসিকের নগর পরিকল্পনাবিদ রেজাউল করিমের কাছে। তিনি সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, প্রবর্তক মোড়ের নাম ঠিক থাকবে। আইয়ুব বাচ্চু চত্বর হবে না। শুধু রূপালী গিটার স্থাপন করা হবে।
উল্লেখ্য, উনিশ শতকের শুরুতে অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী মতিলাল রায় চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবর্তক সংঘ নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অনাথ আশ্রম ও ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করেন। বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল এসব স্থাপনা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে প্রবর্তক সংঘে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে প্রায় সকল কর্মকর্তাকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। ঐতিহ্যবাহী এই প্রবর্তক সংঘের কার্যক্রম এখনো চলছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রবর্তক মোড় একটি ঐতিহ্যবাহী জায়গা। এর নাম পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত করপোরেশনের নেই। এই ব্যাপারে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই। নাম পরিবর্তন সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্তে হয় না। এটি মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন হয়ে আসতে হয়।’
এদিকে আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতিবিজড়িত নয় এমন স্থানে রূপালী গিটার স্থাপন নিয়েও চলছে নানামুখী আলোচনা। এছাড়া প্রবর্তক মোড় সামান্য বৃষ্টিতেও হাঁটু থেকে কোমড় পানিতে তলিয়ে যায়। এই অবস্থায় সেখানে এই নান্দনিক স্থাপনা নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বাচ্চুর কৈশোর-তারুণ্যের সঙ্গীদের কয়েকজন জানিয়েছেন, আইয়ুব বাচ্চুর বেড়ে ওঠা নগরীর মাদারবাড়ি এলাকায়। নিউমার্কেট, কাজীর দেউড়ির মোড়, রিয়াজউদ্দিন বাজার, আউটার স্টেডিয়ামকে ঘিরেই ছিল তার পদচারণা। তার সঙ্গীত জীবনের শুরুও সেখান থেকেই।
স্মৃতিঘেরা জায়গাগুলোর পরিবর্তে প্রবর্তক মোড়কে বেছে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ রেজাউল করিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রবর্তক মোড়ের মতো এত প্রশস্ত জায়গা আর কোথাও পাইনি। যেসব জায়গায় আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে, সেগুলোর নামকরণ হয়ে গেছে।’
গিটারের আদলে ভাস্কর্য করা হলেও আইয়ুব বাচ্চুর পূর্ণাঙ্গ ভাস্কর্য স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের এই কর্মকর্তা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভাস্কর্য বানালে সেটি রাখতে পারব না। ভেঙ্গে দেবে। বাঘের ভাস্কর্য বানিয়েছি, সেগুলোই তো রাখতে পারছি না।’
গত বছরের ১৯ অক্টোবর সকালে রাজধানীতে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আইয়ুব বাচ্চু। চট্টগ্রামে মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয় দেশের ব্যান্ড সংগীতের এই কিংবদন্তিকে।
সারাবাংলা/আরডি/পিএ