Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রেস ক্লাবমুখী আন্দোলনের ক্ষুদ্র অর্থনীতি


২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৬:২০

মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: গেল ডিসেম্বর থেকে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার আন্দোলন চলছে। কোনো পক্ষ দাবি-দাওয়া পাওয়ার আশ্বাসে আন্দোলন শেষ করে বাড়ি ফিরছে তো অন্যপক্ষ এসে ঘাঁটি গাড়ছেন রাজপথে। কখনো কখনো একইসঙ্গে কয়েকটি পক্ষ মিলে ব্যাপক গণসমাবেশে পরিণত করছে রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এ এলাকা। দিনের পর দিন তাদের অবস্থানের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে জনভোগান্তি। তবে আশীর্বাদ হিসেবে এসব আন্দোলনকারীরা অবদান রাখছেন এ এলাকার ক্ষুদ্র অর্থনীতিতে। চায়ের দোকানি থেকে শুরু করে আবাসিক হোটেল মালিক সবার পকেটেই অতিরিক্ত আয় হিসেবে যাচ্ছে রুটি-রুজির জন্য যারা রাজপথে নামছেন তাদের টাকা।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বর্তমানে বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, সাধারণ শিক্ষার্থী পরিষদ ও কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার সিএইচসিপিরা। সোমবার দাবি পূরণের আশ্বাস নিয়ে এ স্থান ত্যাগ করেছে বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরামের কয়েক হাজার শিক্ষক।

নানা আন্দোলনের কারণে সব মিলে গড়ে প্রতিদিন অন্তত এক হাজার অতিরিক্ত মানুষ অবস্থান করছেন জাতীয় প্রেস ক্লাব ও এর আশপাশের এলাকায়। যাদের প্রত্যেকের গড় ব্যয় ৩ শ’ থেকে ৫ শ’ টাকার মধ্যে। এ টাকা তারা থাকা-খাওয়াসহ দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যয় করছেন।

প্রেস ক্লাবের সামনে এ লোকগুলোর অবস্থান হলেও জরুরি প্রয়োজন মেটাতে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয় না সেখানে। এমন কী পাশের সিরডাপ ও তার একটু দূরের শিক্ষা ভবনের গেটও বন্ধ রয়েছে আন্দোলনকারীদের জন্য। জরুরি প্রয়োজন মেটানো তো দূরের কথা নামাজ পড়ার কথা বলেও ঢুকতে পারছেন না ভেতরে। শিক্ষা ভবনের বিশাল গেটে লাগিয়ে ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন টুটুল মিয়া নামের একজন নিরাপত্তাকর্মী। তিনি জানালেন, এ ক’দিন অনেক চাপ যাচ্ছে। উপর থেকে নির্দেশনা দেওয়া আছে যাতে আন্দোলনকারী কেউ ভিতরে ঢুকে বাড়তি ঝামেলা সৃষ্টি না করে।

বিজ্ঞাপন

কদম ফোয়ারা মোড়ে সিরডাপের ওয়াল ঘেঁষে ফুটপাতের উপর রাখা দুটি মোবাইল টয়লেট। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপণায় এগুলোর বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি সংস্থা আরবান। আর ওয়াটার এইড নামের অপর একটি সংস্থা রয়েছে এর সহযোগিতায়। অন্যান্য দিন এ টয়লেটগুলো প্রায় অব্যহৃত থাকলেও বেশ কিছুদিন ধরে সেগুলোর ব্যবহার বেড়েছে কয়েক গুণ। বিভিন্ন আন্দোলনে যারা দিনের পর দিন রাস্তায় থাকছেন তারাই মূলত প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছেন ছোট্ট এ ঘরগুলোয়। এর জন্য ছোট কাজে ৫ টাকা আর বড় কাজের জন্য গুনতে হচ্ছে জনপ্রতি ১০ টাকা করে।

পাশে একটি ছোট্ট টং দোকানে  ব্যস্ত সময় পার করছেন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি মোবাইল টয়লেটগুলো পরিচালনা করেন। সেইসঙ্গে দোকানে কিছু হালকা খাবারও রাখেন। যেগুলোর বিক্রি এখন তুঙ্গে।

তিনি জানান, ‘আজ তিন দিন ধইরা ঘুম নাই, গোসল নাই। অনেক রাতেও লোকজন আসছে। তারা টয়লেট ব্যবহার করছে। টাকা কামাই করতে হইলে তো কষ্ট করতে হইব।’

তার কথায় সায় দেন এ কাজে তার সহযোগী রিনা আক্তার। যিনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এসব আন্দোলনকারীদের হাতে পানি তুলে দেন। যাতে প্রাকৃতিক ক্রিয়া-কর্ম সম্পন্নতে কারো ঝামেলা না হয়।

আব্দুর রাজ্জাক জানান, সাধারণ দিনে এ দুটি টয়লেট থেকে প্রতিদিন আয় হয় দেড় থেকে দু শ’ টাকা। এখন তা গড়ে ১২ থেকে ১৫ শ’ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর জন্য সিটি কর্পোরেশনকে প্রতি মাসে দিতে হয় ৬ শ’ টাকা।

তিনি জানান, কেবল টয়লেট ব্যবহারই নয় বিক্রি বেড়েছে তার টং দোকানেও। কেক, বিস্কুট, কলাসহ শুকনো খাবার বিক্রি করে এখন প্রতিদিন বাড়তি আয় হচ্ছে অন্তত ৫ শ’ টাকা।

আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী স্বাস্থ্যকর্মী উপস্থিত ছিলেন। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, আন্দোলনের কারণে ক্ষুদ্র অর্থনীতিতে গতি প্রবাহ বাড়ার বিষয়টিকে তারা কীভাবে দেখছেন সে বিষয়ে।

এ সময় নড়াইলের কালিয়া উপজেলার অমিত কুমার বলেন, ‘বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। আমরা গ্রামে বসে আয় করে ঢাকায় ব্যয় করছি। এর মাধ্যমে নতুন কিছু মানুষের সঙ্গে লেনদেন হচ্ছে। একটা বিষয় এখানে স্পস্ট তা হলো আমরা বড় কিছু পাওয়ার জন্য এ ক্ষুদ্র ব্যয় করছি। আমাদের অতীব প্রয়োজনীয় খাতেই ব্যয় করছি।’

তার একটু পাশেই কলা-রুটি শেষে গরম চায়ের সঙ্গে আড্ডা জমাচ্ছিলেন নেত্রকোণার কয়েকজন স্বাস্থ্য সহকারী। দাবি বাস্তবায়নে করা কমিটির নেত্রকোণা জেলার সদস্য সচিব মাহবুব আলম নাজিম স্বাস্থ্যকর্মী জানান, তাদের মধ্যে অনেকেই রাতে হোটেলে থাকেন। এক্ষেত্রে ডাবল রুম ভাড়া নিয়ে বেশ কয়েকজন একসঙ্গে থাকছেন। এতে অপেক্ষাকৃত খরচ কমছে। তার মতে, প্রতিদিন প্রত্যেক আন্দোলনকারী গড়ে ৩ থেকে ৫ শ’ টাকা খরচ করছেন। এরমধ্যে টয়লেট ব্যবহার থেকে শুরু করে খাওয়া-ঘুম ও মোবাইলে রিচার্জ রয়েছে বলেও জানান তিনি।

আন্দোলন স্থলে গিয়ে দেখা যায় সেখানে বাদাম, ঝালমুড়ি, চা-কফি থেকে শুরু করে শসা-খিরাই বিক্রি করছেন অনেকেই। এর মধ্যে ভৈরবের কাওসার গত প্রায় এক মাস যাবত প্রেস ক্লাবের সামনেই ঘুরে ঘুরে চীনা-বাদাম বিক্রি করছেন। তিনি জানালেন এখানে বেশি ঘুরতে হয় না। দিন শেষে ১২ থেকে ১৫ শ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে তার।

আন্দোলনের কারণে এ এলাকার প্রতিটি দোকানেই খদ্দের ভরপুর। বিশেষ করে প্রেস ক্লাবের অপর পাশে খাবারের হোটেলগুলোয় দুপুরের খাবার টেবিল ভিড় লেগেই থাকে। তবে আন্দোলনকারীদের বেশির ভাগেরই পছন্দ মাঝারি থেকে সাধারণ হোটেলগুলো। একটু কম দামে অন্তত একবেলা পেটপুরে খাচ্ছেন অনশন কিংবা অবস্থান কর্মসূচি পালনকারী এসব শিক্ষক কিংবা স্বাস্থ্যকর্মীরা।

এ বিষয়ে বিসমিল্লাহ হোটেলের ম্যানেজার কাইউম সারাবাংলাকে জানান, আন্দোলন চলায় অন্যদিনের তুলনায় দেড় থেকে ২ হাজার টাকা বেশি বিক্রি হচ্ছে প্রতিদিন। তার মতে যে হোটেলে যত বেশি জায়গা সেখানে আন্দোলনকারীরা বেশি ঢুকছেন। তারা একসঙ্গে দলবেঁধে খেতে আসছেন।

কেবল পল্টন এলাকাই নয়, আন্দোলনকারীদের ঢেউ লাগছে পাশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেলের মতো কিছু প্রতিষ্ঠানে। যেখানের আবাসিক হলের ডাইনিং কিংবা ক্যাম্পাসের খাবারের দোকানগুলোয় এদের উপস্থিতি চোখে পড়ছে। এ ছাড়া শহরের বাসাবাড়িতেও বাড়তি লোকগুলোর কেউ কেউ ঠাঁই নিচ্ছেন। সেসব জায়গায়ও তারা খরচ করছেন পকেটের টাকা।

আন্দোলনে অংশ নিতে এসে অনেককেই রাস্তায় রাত কাটাতে হচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত শীত বস্ত্র কিনতে হচ্ছে তাদের। সেইসঙ্গে কিনতে হচ্ছে স্যালাইনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধ।

আন্দোলনস্থলে বসে মোবাইলে নিউজ পোর্টাল দেখছিলেন শরীয়তপুরের ফাইজুল ইসলাম নামের একজন শিক্ষক তিনি জানান, দিনের বেলা মোবাইলে বেশি কথা বলা হয় না। তবে রাতে অনেক কথা বলা হয়। ফেসবুকসহ ইন্টারনেট ব্যবহারে তার প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ টাকা খরচ হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

সারাবাংলা/এমএস/আইজেকে

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর