সিনেট অধিবেশনের এজেন্ডায় নেই ‘উপাচার্য প্যানেল’
২৫ জুন ২০১৯ ২০:৫৫
ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান সাময়িকভাবে নিয়োগ পাওয়ার প্রায় দুই বছর পার হলেও পূর্ণাঙ্গ সিনেটে তার অনুমোদন হয়নি। ‘উপাচার্য প্যানেল’ উপস্থাপনের মধ্যদিয়ে নিয়োগ চূড়ান্ত হওয়ার বিধান থাকলেও সে পথে হাঁটছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এরই মধ্যে বুধবার (২৬ জুন) বসছে ঢাবির সিনেট অধিবেশন। দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সিনেটের এই অধিবেশনের এজেন্ডায়ও থাকছে না উপাচার্য প্যানেলের বিষয়টি।
এখন পর্যন্ত উপাচার্য প্যানেল চূড়ান্ত না হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ ভঙ্গ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলছেন সিনেট সদস্যরা। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ ১১-এর ১ ধারা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটের মাধ্যমে একজন নির্বাচিত উপাচার্য থাকবেন। এছাড়া ছয়মাসের মধ্যে সিনেট পূর্ণ করে ‘উপাচার্য প্যানেল’ মনোনীত করার হাইকোর্টের আদেশও অমান্যের অভিযোগ উঠেছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। প্যানেলের মাধ্যমে ভিসি নির্বাচন না দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান আগের উপাচার্যের পথেই হাঁটছেন বলে মন্তব্য করেছেন একাধিক সিনেট সদস্য।
বুধবার (২৬ জুন) ঢাবি সিনেটের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। বার্ষিক অধিবেশনের জন্য আহ্বান করা লিখিত প্রশ্নে দুজন সিনেট সদস্য জানতে চেয়েছেন যে, ‘উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন কবে হবে?’ তবে তারা এর সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর পাননি।
সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন কবে নাগাদ হতে পারে এ প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি শিগগিরই হবে। ’ আদালতের আদেশে আছে, ছয়মাসের মধ্যে সিনেট পূর্ণ করে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করতে হবে- বিষয়টি তাকে অবহিত করলে তিনি বলেন, ‘তাই নাকি? সেটি তো জানি না, দেখতে হবে।’
২০১৭ সালের ২৯ জুলাই সিনেটের বৈঠকে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ‘উপাচার্য নির্বাচনে’ তিন সদস্যের প্যানেল মনোনীত করেন। কিন্তু এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর সেই বিশেষ সভা ও তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেলকে অবৈধ ঘোষণা করেন। পাশাপাাশি আদালত ছয়মাসের মধ্যে যথাযথভাবে সিনেট গঠন করে উপাচার্য প্যানেল মনোনীত করার জন্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়। এরমধ্যেই ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানকে সম্পূর্ণ অস্থায়ীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের আদেশ জারি করেন।
প্রসঙ্গত, ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট, গবেষণা সংস্থার ৫ জন প্রতিনিধি, অধিভুক্ত কলেজের ৫ জন অধ্যক্ষ, পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধিসহ ১০৫ জন সদস্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট গঠিত। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের আমলে সিনেটের ৫০টি পদ শূন্য ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারি রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন, ২০১৯ সালের ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বর্তমান উপাচার্যের আমলে সিনেট পূর্ণ হয়েছে।
১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের কাজ হলো- উপাচার্য নির্বাচন এবং বার্ষিক বাজেট অধিবেশন করা। সেক্ষেত্রে সিনেট তিন সদস্যের ‘উপাচার্য প্যানেল’ নির্বাচন করে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠান। রাষ্ট্রপতি এর মধ্যে থেকে একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী যথাযথভাবে সিনেট গঠিত হওয়ার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের আগামীকালকের অধিবেশনে ‘উপাচার্য প্যানেল’ নির্বাচনের এজেন্ডা রাখেনি কর্তৃপক্ষ।
পূর্ণাঙ্গ সিনেট নিয়ে বুধবার (২৬ জুন) বিকেল তিনটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। এই অধিবেশনের কার্যসূচিতে ৬টি বিষয় রাখা হয়েছে। এগুলো হলো উপাচার্যের অভিভাষণ, কোষাধ্যক্ষের বাজেট উপস্থাপন, পূর্ববর্তী অধিবেশনের কার্যবিবরণী অনুমোদন, ২০১৭-১৮ সালের বার্ষিক বিবরণী বিবেচনা, জগন্নাথ হল ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মনোনয়ন এবং ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য ছয়জনের একটি প্যানেল অনুমোদন।
সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. সাবিতা রিজওয়ানা রহমান বলেন, ‘ছয়মাসের মধ্যে সিনেট পূর্ণাঙ্গ করে প্যানেল দেওয়ার নির্দেশনা আছে আদালতের। আমরা আশা করি সেই সময়ের মধ্যে উপাচার্য ড. আখতারুজ্জামান তা করবেন। ‘ সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনের এজেন্ডাতে প্যানেলের বিষয়টি নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় পরবর্তী কোনো সভায় এটি হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী একজন উপাচার্যকে নির্বাচিত হতে হয়। পূর্ণাঙ্গ সিনেট থাকতে হয়। আমরা সিনেটের বিষয়ে রিট করেছিলাম। এখন সিনেট পূর্ণাঙ্গ হয়েছে। উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের জন্য সবকিছু অনুকূলে আছে। আমরা মনে করি একটি বিশেষ বৈঠক ডেকে প্যানেল করা হবে।’
সিনেট সদস্য ও ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বাহলুল মজনুন চুন্নু বলেন, ‘ভিসি নির্বাচন করতে হলে ১৩দিন আগে নোটিশ দিতে হয়। এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। শিগগিরই হয়ে যাবে। খুব বেশি সময় লাগবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘আগামীকালের সিনেট অধিবেশনের এজেন্ডায় কেন ভিসি প্যানেল নির্বাচনের বিষয়টি রাখা হয়নি, আমরা তার জবাব চাইব। আমরা ভিসিকে অ্যাকিউজড করব। পূর্ণাঙ্গ সিনেট হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি ভিসি প্যানেল দিচ্ছেন না। তিনি আসলে কি চান?’
২৬ জুনের সিনেট অধিবেশনের জন্য ছাপানো লিখিত প্রশ্নোত্তরে দেখা গেছে, সিনেটের দুজন সদস্য সিনেট কর্তৃক উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে জানতে চেয়েছেন। এর মধ্যে সিনেট সদস্য রামেন্দু (কৃষ্ণ) মজুমদার জানতে চেয়েছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের প্রধান দুটি দায়িত্ব হচ্ছে বার্ষিক বাজেট পাস ও উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করা। আমরা রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট কর্তৃক নির্বাচিত সিনেট সদস্যরা দীর্ঘদিন যাবৎ উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়ে চলেছি। উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের জন্য সিনেট অধিবেশন কবে দেওয়া হবে?’ এই প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, ‘বিষয়টি কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় রয়েছে; পূর্ণাঙ্গ সিনেট গঠিত হয়েছে। যথাশীঘ্র সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
লিখিত প্রশ্নোত্তরে একইভাবে বিষয়টি জানতে চেয়েছিলেন সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. সাবিতা রিজওয়ানা রহমান। কর্তৃপক্ষ আগের জনের প্রশ্নের উত্তর দেখতে বলেছেন।
সিনেট অধিবেশনে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের এজেন্ডা না থাকার বিষয় জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের প্যানেল নীলদলের আহ্বায়ক অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনে বাজেট নিয়ে আলোচনা হয় ও অন্যান্য কমিটি গঠন করা হয়। আর সিনেট প্যানেল নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন হয় একটি বিশেষ অধিবেশনের। উপাচার্য একজন প্রতিনিধির প্রশ্নোত্তরে বলেছেন, যথাশীঘ্র সিনেট প্যানেল দেওয়া হবে। আমরা আশা করি, উপাচার্য এই অধিবেশন থেকেই ভিসি প্যানেল নির্বাচনের জন্য বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করবেন।’
অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সময় ১০৫ সদস্যবিশিষ্ট সিনেটে মাত্র ৫০ জন সদস্য থাকায় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সিনেট সদস্যরা। ওই বিশেষসভার নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন শিক্ষকসহ ১৫ জন রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট রিট করেন। এদের মধ্যে অন্যতম একজন রিটকারী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ। আগামীকালকের সিনেটে উপাচার্য প্যানেলের কোনো এজেন্ডা না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা উপাচার্যের এখতিয়ার। এ ব্যাপারে আমার কিছু বলা শোভন হবে না।’
সারাবাংলা/কেকে/পিটিএম