Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেউ এগিয়ে এলে মাকে বাঁচাতে পারতাম


২৯ জুন ২০১৯ ১৬:৩২

ঢাকা: হঠাৎ বাসে একটা সজোরে ধাক্কা! কানে এলো মা জোরে  জোরে দোয়া পড়ছেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাস পানিতে পড়ে গেল । সঙ্গে সঙ্গেই  পানি ঢুকে গেল বাসে। পাশের সিটে তাকিয়ে দেখি মা নেই। মনে হলো আমি অনেক দূরে সরে এসেছি, মা আমার চাইতে দূরে। কোলে আমার ২৩ মাস বয়সী সন্তান। আমি পানিতে ডুবলেও বাচ্চাকে উপড় করে ধরে রেখেছিলাম। পেছন থেকে অন্য যাত্রীরা ধাক্কা দিচ্ছিল। আমি মাকে নিয়েই বের হতে চাইলাম। কিন্তু আশেপাশে কোথাও তাকে খুঁজে পেলাম না। বাস থেকে কোনরকমে মেয়েকে নিয়ে আমি বেরিয়ে আসি।

বিজ্ঞাপন

বাচ্চা কোলে নিয়ে আমি তখন সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলাম। বাসের জানলা ভেঙে আমার মা’কে বের করে আনার আকুতি জানাচ্ছিলাম। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসল না। পরে স্থানীয় দুইজনকে দেখলাম এগিয়ে এসে বলছেন ইট দিয়ে গাড়ির গ্লাস ভাঙতে। আমিও এগিয়ে যাই। হাত দিয়েই গাড়ির মাঝদিকের গ্লাস ভাঙি। কিন্তু মা’কে পেলাম না। তখন আমার বাচ্চার মাথায় রক্তক্ষরণ দেখে স্থানীয়রা আর আমাকে গাড়ির ভেতর যেতে দিল না। কেউ সাহায্য করলে মা’কে বাঁচাতে পারতাম।

বিজ্ঞাপন

কথাগুলো বলছিলেন ডা. সায়েকা সুলতানা। মা ও সন্তানকে নিয়ে তিনি ‘রয়্যাল কোচ’ পরিবহনের একটি বাসে করে গত বৃহস্পতিবার  (২৭ জুন)  যাচ্ছিলেন কুমিল্লা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে যাত্রীবাহী বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়। দুর্ঘটনায় নিহত হন দুইজন। একজন হলেন ডা. সায়েকা সুলতানার মা রওশন আরা বেগম (৬০) ও অপরজন হলেন মুরাদনগর উপজেলার মামুন মিয়ার মেয়ে আনিকা আক্তার তাহসিন (২২)। রওশন আরা বেগম ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা, আনিকা আক্তার তাহসিন কুমিল্লা রাজধানীর কল্যাণপুরে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

আরও পড়ুন :আনিকার চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন কেড়ে নিল সড়ক দুর্ঘটনা

দুর্ঘটনায় আহত ডা. সায়েকা সুলতানা এবং তার সন্তান রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্বামী ডা. শরীফ শাহাদাতও পেশায় ডাক্তার। তিনি জানালেন অস্ত্রোপচার শেষে এখন সুস্থ আছে তাদের সন্তান।

ডা. সায়েকা সুলতানা বলেন, “দুপুর ১টা ৪০ মিনিটের ‘রয়্যাল কোচ’ পরিবহনের বাসে আমরা কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। গাড়িতে শুরু থেকেই সমস্যা ছিল। এসি কাজ করছিল না। ড্রাইভার মোবাইলে কথা বলছিল। গাড়ির সকল যাত্রীরা অভিযোগ জানালেও তাতে কোনো কর্ণপাতই করেননি চালক। কারো কথা না শুনেই সে গাড়ি নিয়ন্ত্রণহীনভাবেই চালাচ্ছিলেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার মা’কে আমি হারালাম। চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি। মা’য়ের দাফনেও থাকতে পারিনি। সন্তান হিসেবে আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না মা নেই। মনে হচ্ছে এই বুঝি মা ফোন করবেন। কুমিল্লা গেলে মা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আমার সন্তানকে কোলে তুলে নিবে। কিন্তু একটি ত্রুটিযুক্ত গাড়ি এবং একজন বেপরোয়া চালকের কারণে আজ আর আমি মাতৃহীন হলাম।’

সায়েকা জানান, বাসটি দুর্ঘটনার আগে একবার একটি প্রাইভেট কারকে ধাক্কা দেয়, পরে একটি কাভার্ড ভ্যান বাসটিকে প্রায় চাপা দিতে নেয়। এছাড়া বাস চালক কিছুক্ষণ পরপরই মুঠোফোনে কথা বলছিলেন।

তিনি বলেন, ‘গাড়ি চালানোর সময় যাতে চালকরা মোবাইল ফোনে কথা না বলে সে বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও পরিবহন নেতাদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত। অন্যথায় সড়কে মৃত্যু মিছিল থামবে না।’

দুর্ঘটনায় ফেলে আসা ব্যাগ আজ পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তাতে রওশন আরা বেগমের ব্যাগে থাকা ২০ হাজার টাকা ও মোবাইল পাওয়া যায়নি ।

সেদিনের ওই বাস দুর্ঘটনায় মারা গেছেন  রাজধানীর কল্যাণপুরে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী আনিকা আক্তার তাহসিনও  (২২)।

এর আগে বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) বিকেলে দাউদকান্দি উপজেলার টামটা এলাকায় বাস খাদে পড়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে সারাবাংলাকে নিশ্চিত করেন ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) কে এম মো. মনিরুল ইসলাম।

মনিরুল ইসলাম জানান, বাসটি উদ্ধার করে আটক রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৭ জুন)পুলিশ বাদী হয়ে দাউদকান্দি মডেল থানায় একটি মামলা করেছে। মামলা নাম্বার ৪৮। মামলাটি দায়ের করেছেন সহকারি টাউন উপপরিদর্শক (এটিএসআই) রায়হান। বাসের চালক এখনো অজ্ঞাত। ‘রয়্যাল কোচ’ পরিবহন কর্তৃপক্ষের কেউ এখনো থানায় আসেননি গাড়ির কাগজপত্র বুঝে নিতে।

এদিকে এই ঘটনায় গাড়ির চালকের গাফিলতির প্রসঙ্গে ‘রয়্যাল কোচ’ পরিবহন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও কেউ ফোন রিসিভ করেননি।

সারাবাংলা/এসবি/জেডএফ

কুমিলা বাস দুর্ঘটনা মা রয়্যাল কোচ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর