সমুদ্রপাড়ে মাদক ঠেকাতে ৩০ দিনে ১৪ ‘বন্দুকযুদ্ধ’, ২৩ লাশ
২ জুলাই ২০১৯ ০৯:০৪
কক্সবাজার: মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণে কঠোর অবস্থানে রয়েছে কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একইসঙ্গে মানব পাচারের বিরুদ্ধেও সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব), পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এর ফলে জেলার বিভিন্ন স্থানে মাদক বিক্রেতা ও মানব পাচারকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনা ঘটছে নিয়মিতই। গত জুন মাসের হিসাবে এমন ঘটনা ঘটেছে এই জেলায় ১৪টি। আর তাতে ২৩ জন মাদক বিক্রেতা ও মানব পাচারকারী মারা গেছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, কক্সবাজারকে মাদক ও মানব পাচারমুক্ত করতে প্রশাসন রয়েছে ‘হার্ড লাইনে’। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এসব অভিযানকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি সচেতন নাগরিকরা বলছেন, এ ধরনের অপরাধে প্রশাসনের কেউ জড়িত থাকলে তাদেরও কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হোক।
একমাসে ১৪ ‘বন্দুকযুদ্ধ’
কক্সবাজার র্যাব-১৫-এর কমান্ডিং অফিসার (সিও) উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ, টেকনাফ (২) বিজিবি’র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়সাল হাসান খাঁন ও জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাসে ১৪টি ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনায় ২৩ জন মাদক বিক্রেতা ও মানব পাচারকারীর মৃত্যু হয়েছে।
২৫ জুন দিবাগত রাত ৩টার দিকে টেকনাফের মহেশখালীয়া পাড়ার নৌকাঘাট এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিন মানব পাচারকারীর মৃত্যু হয়। তারা হলেন— টেকনাফের সাবরাং নয়াপাড়ার গোলা পাড়ার আবদুল শুক্কুরের ছেলে কোরবান আলী (৩০), কে কে পাড়ার আলী হোসেনের ছেলে আবদুল কাদের (২৫) ও একই এলাকার সুলতান আহমদের ছেলে আবদুল রহমান (৩০)। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় তিনটি দেশীয় অস্ত্র ও গুলি। এ ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হন।
গত ২৩ জুন দিবাগত রাত দেড়টার দিকে টেকনাফের সাবরাং কাটাবনিয়া নৌকাঘাট এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মোহাম্মদ রুবেল (২৩) ও মোহাম্মদ ফারুক (১৯) নামে দুই মানব পাচারকারী মারা যান। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় দুইটি দেশীয় অস্ত্র ও গুলি।
গত ২৮ জুন দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে উখিয়ায় রহমদের বিল সীমান্তে বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মো. নুর (২৭) নামে এক রোহিঙ্গা ইয়াবা পাচারকারীর মৃত্যু হয়। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় ১৫ হাজার পিস ইয়াবা, একটি অস্ত্র ও গুলি।
গত ১৫ জুন দিবাগত রাতে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শহরের বাজার ঘাটা এলাকার বড় এক কারবারিসহ টেকনাফের তিন মাদক বিক্রেতার মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন— শহরের আইভিপি সড়কে মাদকের পাইকারি দোকানদার শহিদুল ইসলাম লিটন (৪২), টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা এলাকার গবি সোলতানের ছেলে দিল মোহাম্মদ (৪২) ও নাইক্ষ্যংছড়ির রাশেদুল ইসলাম সৌরভ। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার কর হয় এক লাখ ৪০ হাজার পিস ইয়াবা, চারটি অস্ত্র ও গুলি।
গত ১৬ জুন সকাল ৭টার দিকে কক্সবাজার সদর উপজেলা ঈদগাঁও-ঈদগড় সড়কের জঙ্গলের পাশের এরালা থেকে শহরের শীর্ষ ইয়াবা বিক্রেতা রফিকুল ইসলামের (৩৮) গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনাস্থলে ইয়াবা ও অস্ত্র পাওয়া যায়।
গত ১০ জুন দিবাগত রাত ২টার দিকে টেকনাফের হ্নীলা’র জাদিমোরা এলাকায় বিজিবি’র সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একজনের মৃত্যু হয়। বিজিবি’র দাবি, তিনি ইয়াবা বিক্রি করতেন। তবে তার নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। ঘটনাস্থল থেকে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
গত ৩ জুন দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং পচাখালী সেতু সংলগ্ন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মোহাম্মদ মফিজ আলম নামে এক ইয়াবা ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়। ঘটনাস্থল থেকে চারটি দেশীয় বন্দুক, গুলি ও তিন হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
এর আগে, জুন মাসের শুরুতেই টেকনাফের স্থলবন্দর সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন নাফ নদীর তীরে চারটি অস্ত্র ও এক লাখ ইয়াবা সঙ্গে নিয়ে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নম্বর তালিকাভুক্ত ‘ইয়াবা ডন’ সাইফুল করিম (৪৫) মারা যান।
স্থায়ী সমাধানের প্রত্যাশা
র্যাব, বিজিবি ও পুলিশের এসব অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে কক্সবাজার মাদক নিরাময় কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ বলেন, মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের এই সাঁড়াশি অভিযানকে স্বাগত জানাই। এই অভিযান অনেক আগে থেকে শুরু করা দরকার ছিল। তাতে অনেক তরুণ ভয়ংকর মাদক থেকে মুক্ত থাকতে পারত। নিজেকে অন্ধকার জগতে ঠেলে দিত না। এই অভিযান অব্যাহত থাকুক।
মানবাধিকারকর্মী কলিম উল্লাহও বলছেন, মাদক নির্মূল হোক— এ প্রত্যাশা সবার। তবে এর জন্য ‘বন্দুকযুদ্ধ’কে চূড়ান্ত সমাধান মনে করেন না তিনি।
কলিম উল্লাহ বলেন, ‘বন্দুকযুদ্ধে’র মাধ্যমে মাদকের কারবারিদের মেরে ফেলাটাই সমাধান নয়। সমস্যার মূলে আঘাত করতে হবে। মাদক যে পথে আসছে, সেই পথ বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে সে বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।
এই মানবাধিকারকর্মী আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যও কিন্তু মাদকসহ আটক হয়েছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাইনি। তাই প্রশাসনের কাছে অনুরোধ থাকবে, আইন যেন সবার জন্য সমান থাকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, মাদক ও মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। আর অপরাধীরা প্রশাসনের কেউ হোক আর যত প্রভাবশালীই হোক, কারও জন্য ছাড় নেই। মাদক ও মানব পাচারে যেই জড়িত থাকবে, তাকেই আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হবে।
সারাবাংলা/টিআর