কক্সবাজার: ছবির বাম পাশের ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আবছার (২৩)। হালকা-পাতলা গড়নের হাসি-খুশি চেহারার আবছার কক্সবাজারের শহীদ সরণির একটি মোটর সাইকেলের গ্যারেজে মেকানিক হিসেবে কাজ করতেন।
মোহাম্মদ আবছার মারা গেছেন, দুটি কিডনি বিকল হয়ে মৃত্যু হয়েছে তার।
কথা হয় আবছারের দুই বন্ধু রুবেল আর রিপনের সঙ্গে। তারা জানালেন, মৃত্যুর আগে আবছার প্রায়ই বলতেন যে তার শরীর দুর্বল। তিনি মোটা হতে চান। এর কয়েকদিন পরেই মোটা হওয়ার কিছু ওষুধ খেতে শুরু করেন তিনি। যার ফলাফল হিসেবে তার হাত, মুখ ও গলার নিচের অংশ চোখে পড়ার মতো মোটা হয়ে যায়।
এসব ঘটনার কিছুদিন পরে আবছারের আর দেখা পাচ্ছিলেন না তার বন্ধুরা। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, অসুস্থ হয়ে পড়ায় ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছেন তিনি। সবশেষ রোজার মাসে জানা যায়, ২৫ রমজানের দিন মারা গেছেন আবছার। আর তার মৃত্যু হয়েছে দুটি কিডনি বিকল হয়ে।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার লোহাগাড়ার বাসিন্দা ছিলেন মোহাম্মদ আবছার। তার বড় ভাই সাইফুল ইসলাম জানান, চিকিৎসায় জানা যায়, দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আবছারের। তাদের মা ছেলেকে একটি কিডনি দিতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, আবছারের এইচবিএস এজি পজেটিভ হওয়ায় কিডনি প্রতিস্থাপনের পরও তার বাঁচার সম্ভাবনা ছিল না। ফলে রোগ ধরা পড়ার মাত্র নয় মাসের মধ্যে তিনি মারা যান।
আবছার স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য কিছু ওষুধ সেবন করতে জানিয়ে তার বড়ভাই বলেন, চিকিৎসক জানিয়েছেন ওইসব ওষুধই তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এসবের কারণেই তার কিডনি নষ্ট হয়ে যায়।
একই ধরনের ওষুধ সেবন করে মারা গেছেন পেকুয়া উপজেলার শিলখালী এলাকায় রহিম উদ্দিনের মেয়ে পারবিন আক্তার (১৯)।
পরিবারের সদস্যরা জানান, একজন প্রবাসীর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল পারবিনের। কিন্তু হালকা-পাতলা গড়নের পারবিন নিজেকে দুর্বল মনে করতেন। তাই এলাকার এক পরিচিতজনের পরামর্শ অনুযায়ী চকরিয়ার একটি ফার্মেসি থেকে মোটা হওয়ার ওষুধ কিনে খেতে শুরু করেন। এরপর তার শরীর ফুলে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
আবছার ও পারবিনের মতো কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকার অনেকেই মোটা হওয়ার আশায় বিভিন্ন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করছেন। এসব ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে দীর্ঘ মেয়াদে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। আবার মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য রোগী সেজে ফার্মেসিতেও যান সারাবাংলার এই প্রতিবেদক। মোটা হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে তার কাছেও এসব ওষুধ বিক্রি করা হয়।
মূলত, কিছু ওষুধের দোকানের মালিক ও ভুয়া চিকিৎসকরা অতিরিক্ত লাভের আশায় রুচি বাড়ানো ও মোটা হওয়ার নামে ওরাডিক্সন, পিরিটটিন ও বিফি ফরটি ফোর সহ বিভিন্ন ওষুধ বিক্রি করছেন। এমনও প্রতিষ্ঠানের ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে যেগুলোর কোনো বৈধতা নেই। হারবাল ওষুধ নামে বিক্রি হচ্ছে ভেনাপ্র, পুদিনা এস, রুচি নিড, রুচি প্লাস, আমলকি প্লাস, হেমোডেন, পুদিনা এস। এছাড়া এমভিট এবং রুচিট্যাব নামের ক্যাপসুলও বিক্রি হচ্ছে দেদারসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ওষুধের দোকানের মালিক জানান, মূলত বেশি লাভের আশায় এসব ওষুধ বিক্রি করেন তারা। কারণ যারা ওজন বাড়াতে চান তারা এজন্য যে কোনো মূল্য দিতে রাজি থাকেন। তারা টার্গেট হিসেবে বেছে নেন তুলনামূলক কম শিক্ষিত ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা মানুষকে। এসব মানুষ দোকানে এসে মোটা হওয়ার বা রুচি বৃদ্ধির কিছু কিনতে চাইলে তাদের ধরিয়ে দেওয়া হয় এসব ওষুধের কোর্স। সঙ্গে বিভিন্ন লোভনীয় উপায়ে এসব ওষুধের গুণগান গাওয়া হয়। এসব ওষুধের দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা হলেও বিভিন্ন আকর্ষণীয় নামে প্যাকেজ সাজিয়ে এগুলো বিক্রি করা হয় এক থেকে পাঁচ হাজার টাকায়।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, চিকিৎসার জন্য অনেক সময় রোগীকে স্টেরয়েড দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন বা পরিমানে বেশি স্টেরয়েড সেবন করলে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। এসব ওষুধ খাওয়ার পরে অনেক সময় ঘুম বেড়ে যায় এবং খাবারের রুচি বাড়ে। এই অবস্থা দেখা দিলে লোকজন মনে করে ওষুধে মনে হয় কাজ হচ্ছে। এছাড়া এরই মধ্যে ওষুধ গ্রহণকারীর মুখ, পেট, গলা সহ শরীরের বিভিন্ন নরম অংশ মোটা দেখাতে শুরু করে। এটি দেখে ওই ওষুধ সেবনকারী আরো উৎসাহী হয়ে পড়েন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি মোটা নয়, এটি হলো চামড়ার নিচে পানি জমে যাওয়া।
বাজারে সহজলভ্য এসব স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে এই চিকিৎসক আরও বলেন, এই ধরনের ওষুধ খাওয়ার ফলে ধীরে ধীরে কিডনি কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, চেহারা ফুলে যায়, চামড়ার নিচে পানি জমে যায়, হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে যায়, এলার্জির সমস্যা বেড়ে যায়, ডায়বেটিস ধরা পড়ে, হরমোন পরিবর্তন হয়। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা হয় সেটা হলো রোগ প্রতিরোগ একেবারে কমে যায়। ফলে হয় রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, নাহয় স্থায়ীভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
স্টেরয়েড বা ক্ষতিকর ওষুধের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কঠোর আইন প্রয়োগের ওপর জোর দিলেন জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. মহিউদ্দীন মোহাম্মদ আলমগীর। তিনি জানান, এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সর্তক করতে বিভিন্নস্থানে প্রচার চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রাম-গঞ্জে। যারা টাকার লোভে এসব ওষুধ বিক্রি করছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। জনগণ সচেতন হলে এবং দোষীদের আইনের আওতায় আনা গেলে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
সারাবাংলা/এসএমএন