চীনের ‘যন্তর-মন্তর’ ঘর: কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে উইঘুর মুসলিমদের?
৫ জুলাই ২০১৯ ১২:২২
তাদের অনেকেই কোনো অন্যায় করেননি। যা করেছেন সেটাকে সর্বোচ্চ ‘ভুল’ বলা চলে। এই ধরুন মোবাইলে হোয়াটস অ্যাপ ডাউনলোড করা অথবা দেশের বাইরে যোগাযোগ করা! আবার অনেকে কিছুই করেননি। তবু চীনা কর্তৃপক্ষ ভেবে নিয়েছে এদের উদ্দেশ্যে খারাপ। এরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়াসহ গুরুতর কোনো অপরাধ করতে পারে। তাই তাদেরও নেওয়া হচ্ছে ‘সংশোধন কেন্দ্রে’। এমনটাই ঘটছে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের মুসলিম অধ্যুষিত উইঘুরে। পশ্চিমাদের ভাষায় এসব হচ্ছে ‘মোগজ ধোলাই কেন্দ্র’। সত্যজিৎ রায় ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে যেসবের নাম দিয়েছিলেন ‘যন্তর-মন্তর’ ঘর।
জিনজিয়াং প্রদেশে বিদেশি সাংবাদিকরা ২৪ ঘণ্টা কঠোর নজরদারির মধ্যে থাকেন। তাই খুব সহজে তারা সাক্ষাৎকার ও সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেন না। তবে উইঘুর থেকে মুসলিম দেশ তুরস্কে পালিয়ে যাওয়া অনেকে বিবিসিকে বলেছেন, চীনে সংশোধন কেন্দ্র নামে যেগুলো চলছে সেগুলো আসলে বন্দিখানা। অনেকেই তাদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন। এছাড়া, শিশুদেরও সরকারের তত্ত্বাবধানে স্কুলে নেওয়ার নাম করে পরিবারের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। যেন তাদের ভাষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া যায়। শিশুদের জন্য বানানো এসব কথিত স্কুলের সংখ্যা উইঘুরে দিনে দিনে বাড়ছেই।
তথ্যমতে, শুধু একটি শহরেই ৪০০’র বেশি শিশু নিখোঁজ, এমনকি তাদের বাবা-মা’রাও। তারা হয়তো আছেন সংশোধন কেন্দ্রে নয়ত কারাগারে। কোন কোন শিশুদের ওসব বিদ্যালয়ের ‘রাষ্ট্রীয় শিক্ষা’ প্রয়োজন তা নিয়ে রীতিমত যাচাই-বাছাই চালানো হয়। ধীরে ধীরে বাচ্চাদের পূর্ব পরিচয় ভুলিয়ে দেওয়া হয়।
চীনা কর্তৃপক্ষ মগজ ধোলাইয়ের এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছে। তারা বাছাই করা সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। দেখানো হচ্ছে, ওসব সংশোধন কেন্দ্রের বাসিন্দারা নাচ-গান করছে, ছবি আঁকছে, পড়ালেখা করছে। এভাবেই তারা নাকি স্নাতক পাশ করে। সাংবাদিকদের দেখে একটি কক্ষে কয়েকজন তড়িঘড়ি করে বিছানা গোছাতে শুরু করলেন। বিবিসির সাংবাদিক যখন সংশোধন কেন্দ্রের প্রতিনিধিকে জিজ্ঞেস করেন, এরা কি করছে?
উত্তর এল, বিছানা গোছানো শিখছে।
-কদিন লাগবে শিখতে?
-দুই থেকে চার বছর।
-বিছানা গোছানো শিখতে চার বছর?
-সবার এত সময় লাগে না। কেউ কেউ দুই বছরেই শিখে ফেলে।
তাজ্জব বনে যাওয়া সাংবাদিক নিশ্চিত হলেন এখানে কিছু একটা ‘ভুল’ আছে। সবই যেন সাজানো নাটক। ওসব সংশোধন কেন্দ্রের প্রতিনিধিরা কখনো স্বীকার করতে চান না ওগুলো ‘জেল’। কারণ পৃথিবীর কোনো জেলে কি কাউকে ছবি আঁকতে দেওয়া হয়? গাইতে দেওয়া হয় গান?
এক বাসিন্দাকে জিজ্ঞেস করা হয়, এখানে তারা ধর্ম পালন করতে পারেন কি না? সে উত্তরে জানায়, চীনে জন পরিসরে ধর্মকর্ম করা নিষেধ। স্কুলকেও তেমনটাই ভাবা হয়।
বৈদ্যুতিক আচ্ছাদন ও নিরাপত্তা ঘেরা উঁচু উঁচু সেসব ভবনকে দেশটির কর্তৃপক্ষ বলছে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ‘ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার’। ফোনে কথা বলা, পরিবারের সঙ্গে দেখা করা সবই সেখানে নিষিদ্ধ। উগ্রপন্থা থেকে দূরে রাখতে বন্দিদের কারিগরি ও রাষ্ট্রীয় নিয়ম সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া উচিত বলে মনে করে চীন।
জিনজিয়াং-এ ২০১৭ সালে একবছরেই কিন্ডারগার্ডেনে ভর্তি হওয়া শিশুদের সংখ্যা বেড়েছে ৫ লাখেরও বেশি। উইঘুরে এই বৃদ্ধির হার শতকরা ৯০ ভাগের বেশি। আর তাই জিনজিয়াং চীনে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে এখন শীর্ষে অবস্থান করছে। চীন সেখানে সংশোধন কেন্দ্র, বন্দি শিবির বা যন্তর-মন্তর ঘর যাই বলি না কেন, বানাতে খরচ করেছে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে পালিয়ে আসা উইঘুরের চীনা নাগরিকরা তাদের সন্তানদের ছবি সাংবাদিকদের দেখিয়েছেন। তারা তাদের সন্তান হারিয়েছেন। কেউ কেউ শুনেছেন তাদের ‘এতিমখানায়’ নেওয়া হয়েছে। তারা কাঁদছেন। হারানো ছেলেমেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার সামর্থ্য নেই তাদের।
সারাবাংলা/এনএইচ