‘অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদকে হেনস্থার পেছনে স্বার্থবাদী রাজনীতি’
৬ জুলাই ২০১৯ ২২:১৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউএসটিসিতে হেনস্থার শিকার অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের পক্ষে এক কাতারে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন ও নাগরিক সমাবেশ করেছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা। সমাবেশে একুশে পদকপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী আবুল মোমেন প্রবীণ অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদকে হেনস্থার পেছনে ‘স্বার্থবাদী রাজনীতি’ জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন। শিক্ষকের ওপর হামলার দায় সরকার এড়াতে পারে না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
শনিবার (৬ জুলাই) বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে ‘সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন নাগরিক সমাজের’ ব্যানারে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে শিক্ষক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন।
কবি আবুল মোমেন বলেন, ‘অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের ওপর হামলা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর হামলা, মানুষের বাকস্বাধীনতার ওপর হামলা, উচ্চশিক্ষার পথে হামলা। আজ বাংলাদেশ এমন একটি বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে জ্ঞানচর্চা ও মুক্তির আন্দোলন পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষের সৃজনশীলতাকে বিভিন্ন পশ্চাৎপদ মতবাদের নামে বাধা দেওয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, জ্ঞানচর্চা করতে গিয়ে অনেক জ্ঞানী-মেধাবী মানুষ মূর্খ, অন্ধকারের শক্তির হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। কিন্তু মাসুদ মাহমুদের ওপর যে হামলা সেটা শুধু অন্ধকারের শক্তির হামলা নয়, এর পেছনে আছে স্বার্থবাদী রাজনীতি আর ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতির ব্যবহার। আমরা যতটুকু জানি, অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন। উচ্চশিক্ষার পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তিনি তাদের বিরুদ্ধে কাঁটা হয়েছিলেন। তারাই স্বার্থবাদী রাজনীতির ইন্ধনে মাসুদ মাহমুদের ওপর হামলা করেছে।’
সমাবেশে এসেছিলেন অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের সহধর্মিণী নাসিমা আক্তার। তিনি বলেন, “মাসুদ মাহমুদকে ডেকে নিয়ে ইউএসটিসি’র ইংরেজি বিভাগের উপদেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি ইউএসটিসি’র ইংরেজি বিভাগকে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিভাগ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এটাই ওনার অপরাধ। তাকে যেভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে, এই যে কষ্ট-অপমান, এটার লাঘব কিভাবে হবে আমরা জানি না। ৪০ বছর ধরে উনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি উনি কোনোদিন হননি।”
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘ছাত্র নামধারী একদল দুর্বৃত্ত, যারা পড়ালেখা করে না, নিয়মিত ক্লাস করে না তারাই একজন শিক্ষকের গায়ে হাত দিতে পারে। আর এদের পেছনে আছে শিক্ষক নামধারী কিছু কুলাঙ্গার-দালাল। আরও আছে কিছু রাজনৈতিক নেতা। রাজনৈতিক কারণে বিচার না হওয়ার, অপরাধ করে পার পাওয়ার একটি সংস্কৃতি আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে। এর ফলে সমাজের দুর্বৃত্তরা সাহসী হয়ে উঠছে, যার প্রমাণ মাসুদ মাহমুদের মতো একজন শিক্ষকের ওপর হামলা। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার বিচার হতেই হবে।’
সমাবেশে বক্তারা ঘটনার জন্য ছাত্রলীগের একাংশকে দায়ী করে বলেন, ‘খবরে আমরা জেনেছি- মাসুদ মাহমুদের ওপর হামলায় ইন্ধন দিয়েছে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা। ছাত্রলীগ দুর্বৃত্তদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠুক, সেটা আমরা চাই না। কিন্তু এই ঘটনা সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে- ক্ষমতা আর দুর্বৃত্তায়নের কারণে আমাদের ছাত্র সংগঠনগুলো কোথায় নেমে গেছে।’
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের উদ্দেশে বক্তারা বলেন, ‘আপনি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে। আপনার বাবা মেয়র ছিলেন, তিনি শিক্ষকদের খুবই সম্মান করতেন। যে অপকর্ম একজন শিক্ষকের সঙ্গে হয়েছে, আপনি এর বিচার নিশ্চিত করবেন। শিক্ষা উপমন্ত্রী হিসেবে আপনি শিক্ষকদের পাশে থাকবেন। পুলিশ যাতে এই ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় নিতে কোনো গড়িমসি করতে না পারে, সেটা আপনি দেখবেন।’
আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসানের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম মোস্তফা, আবুল মনসুর, মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও দুরদানা মতিন, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটির সভাপতি ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম, নারীনেত্রী নুরজাহান খান বাদল, গণজাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. চন্দন দাশ, কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কলিম সরওয়ার, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্তা, শিক্ষিকা সেলিনা শেলী, নাট্যজন শুভ্রা বিশ্বাস, নারায়ণহাট কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আনোয়ারুল করিম, সংস্কৃতিকর্মী রুবেল দাশ, আবৃত্তিশিল্পী সেলিম রেজা সাগর, দেবাশীষ রুদ্র ও মামুরা মমতাজ দীপা।
উল্লেখ্য, ২ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) ইংরেজি বিভাগের উপদেষ্টা অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদকে অফিস থেকে টেনে বের করে রাস্তায় নিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে লাঞ্ছিত করে একদল শিক্ষার্থী। এরপর ওই শিক্ষার্থীরাই আবার নগরীর খুলশীতে ইউএসটিসি ক্যাম্পাসের সামনে প্রায় একঘণ্টা ধরে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
এই ঘটনার পর ইউএসটিসি’র ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র মাহমুদুল হাসানকে (২২) ক্যাম্পাস থেকে গ্রেফতার করে নগরীর খুলশী থানা পুলিশ। ইউএসটিসি’র ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার দিলীপ কুমার বড়ুয়া বাদি হয়ে শিক্ষককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় শুধুমাত্র মাহমুদুলকে আসামি করা হয়। আদালতের নির্দেশে মাহমুদুলকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
সারাবাংলা/আরডি/এমও