বিকল্প না রেখে রিকশা উঠিয়ে দেওয়ায় ক্ষোভ
৮ জুলাই ২০১৯ ০৯:১৬
ঢাকা: ‘চোখের সামনে দিয়ে তো দশটার বেশি বাস গেল। একটাতেও উঠতে পারলাম না। যতগুলো বাস গেল সবগুলোর গেইট লক। এভাবেই তো প্রতিদিন বাসের জন্য যুদ্ধ করি। কোনোদিন পাই আবার কোনোদিন না পেয়ে রিকশায় চড়ে বাসায় যাই। ভাবলাম একটা না একটা বাসে তো ঠাঁই হবেই। যাত্রীর চাপ কম থাকবে। কিন্তু তাও পাচ্ছি না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত ইশারা করেই যাচ্ছি।’
রাজধানীর মালিবাগ মোড়ে ফরচুন মার্কেটের সামনে কথাগুলো বলছিলেন রুপ্তা ইয়াসমিন নামে একজন অপেক্ষমাণ বাসযাত্রী। আধাঘণ্টার বেশি সময় ধরেও বাসের অপেক্ষা করেও কোনো বাসে উঠতে পারেননি তিনি।
রুপ্তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, রাজধানীর প্রধান দুই সড়কে রিকশা চলবে না। আপনার মন্তব্য কি? ক্ষোভ প্রকাশ করেই এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘যারা বলছে রিকশা তুলে নেবে তারা কি অনুভব করেছে কীভাবে আমরা প্রতিদিন চলাচল করি। এসি রুমে বসে যা ইচ্ছা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।’
আরেক যাত্রী লিমন সারাবাংলাকে বলেন, ‘রিকশা তুলে দেবে ভালো কথা। সবাই বলছে, রিকশা যানজট বাড়ায়। কিন্তু রিকশায় কি আমরা ইচ্ছে করে চড়ি? নিরূপায় হয়েই তো রিকশায় উঠি। ধরেন, মালিবাগ থেকে রামপুরায় যদি বাসে যায় তাহলে দশ টাকা। আর যদি রিকশায় যায় তাহলে খরচ হয় ৫০ টাকা। এখন কেউ কি চাইবে তার বাড়তি ৪০ টাকা খরচ হোক। তাই আমরাও রিকশা তুলে নেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের বিকল্প কী?’
আমরা যারা রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও একটা বাসে উঠতে পারি না তাদের জন্য বিকল্প কী ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে? প্রশ্ন রাখেন এই এ যাত্রী।
রিকশা এমন শঙ্কা শুধু লিমন কিংবা রুপ্তার নয়। রাজধানীতে প্রতিদিন গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে রিকশা ব্যবহারকারী অসংখ্য যাত্রীর মনেই এই শঙ্কা- রিকশার বিকল্প কী থাকছে? যদি গণপরিবহনই একমাত্র বিকল্প হয় সেটি কি পর্যাপ্ত হবে? কিংবা কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্যময় হবে?
একই প্রশ্ন রিকশা চালকদেরও। তারাও বলছেন, রিকশা যদি না চালাতে পারেন তাহলে সংসারে আর্থিক টানাপোড়ন মিটবে কী করে। বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই এমন সিদ্ধান্ত তাদের জীবনে কেমন প্রভাব ফেলবে সেই চিন্তায় আপাতত অস্থির তারা।
কাকরাইল মোড়ে কথা হয় কবির মিয়া নামের চল্লিশোর্ধ একজন রিকশা চালকের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘যদি রিকশা চালাতে না দেয় তাহলে ঘরে বউ-ঝি’র (স্ত্রী-সন্তান) মুখে খাওন দিমু কেমনে? নিজেরা চলমু কেমনে? আমগো কথা কি কেউ ভাবব?’
তিনি আরও বলেন, ‘হুনছি মেইনরোডে উঠতে দিবো না। কিন্তু মেইন রোডে না উঠলে অল্প জায়গায় সারাদিন কয়টা টিপ মারমু। কয় ট্যাকায় বা ইনকাম করমু। কোনো কিছুই তো মাথায় ধরে না।’
ঘরে তার ১২ বছরের একটা মেয়ে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, রিকশা চালিয়েই তার চিকিৎসার খরচ চালাচ্ছেন কবির মিয়া। এ কথা বলেই গোমড়া মুখে রিকশার প্যাডেল মারতে মারতে শান্তিনগরের দিকে চলে যান তিনি।
গত রোববার (৭ জুলাই) থেকে কুড়িল-রামপুরা-সায়েদাবাদ গাবতলী-আসাদগেট-আজিমপুর ও সায়েন্সল্যাব- শাহবাগ এ তিনটি রুটে সকল রিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। গত ৩ জুলাই নগরীতে পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরি আনতে গঠিত বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন।
তিনি বলেছিলেন, নগরীতে গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধান সড়কগুলোতে রিকশা উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এমন ঘোষণার পর রিকশা চালক ও যাত্রীদের মাঝে বিকল্প ভাবনা নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়।
তবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন সিদ্ধান্তে শঙ্কা প্রকাশের কিছু নেই। যাত্রীদের কথা ভেবেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রিকশা না থাকলে সড়কে যানজট কমবে। এতে দুর্ভোগ কমবে। সেই সঙ্গে রিকশা চালকরাও নেটওয়ার্কিং সড়কগুলোতে রিকশা চালাতে পারবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
কিন্তু নগর পরিকল্পনাবিদ ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো কিংবা যানজটের জন্য শুধুমাত্র রিকশা এককভাবে দায়ী নয়। এ জন্য প্রাইভেটকার ও সিএনজিসহ অন্যান্য একাধিক কারণও রয়েছে। তাই যানজট নিরসনের নামে হুট করে শুধুমাত্র রিকশা তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু অন্যান্য সমস্যার সমাধান না করে রিকশা তুলে দিলে চালক-যাত্রী উভয়কে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ফুটপাত মুক্তকরণ এবং সর্বোপরি সড়কে আইন মেনে চলার মতো কাজগুলো যদি নিশ্চিত করা যায় তবেই স্মার্ট সিটির যে পরিকল্পনা হচ্ছে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবীব সারাবাংলাকে বলেন, সড়কে যানজট রোধে রিকশা তুলে দেওয়া হচ্ছে। এমন সিদ্ধান্তকে অবশ্যই স্বাগত জানাই। কিন্তু শুধুমাত্র রিকশা তুলে দিলেই যানজট নিয়ন্ত্রণ হবে না। যাত্রী বা পথচারীদের সুবিধা বিবেচনায় সড়কে থাকতে হবে পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রাখতে হবে ফুটপাত। কিন্তু দুঃখজনক কথা হল- এ দুইটার একটাও বাস্তবায়ন না করে যদি হুট করে রিকশা তুলে দেয়া হয় তাহলে আরও দুর্ভোগে পড়বে যাত্রীরা। কারণ শহরে যে পরিমাণ গণপরিবহন চালু আছে তা একেবারেও অপর্যাপ্ত। আবার পথচারীরা ফুটপাত ধরে পায়ে হেঁটেও গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না কারণ ফুটপাতগুলোও থাকে দখলে। সুতরাং এগুলোর আগে সমাধান করতে হবে।’
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামছুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘রিকশা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এটি হঠাৎ না করে যদি সময় নিয়ে আরেকটু সহনীয় হয়ে কাজ করা হয় তাহলে রিকশা চালক এবং যাত্রী উভয়ই উপকৃত হবেন।’
রিকশা তুলে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘রিকশা তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও একদিনেই যে রিকশা তুলে দেয়া হবে তা কিন্তু নয়। ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হবে। কারণ রিকশা তুলে দিয়ে বিকল্প হিসেবে গণপরিবহন পর্যাপ্ত নিশ্চিত করতেও তো কিছুদিন সময় লাগবে। এজন্য এ সিদ্ধান্তটি প্রাথমিকভাবে কার্যকরিতা কেমন হবে সেটিও যাচাই-বাছাই করা হবে। আর এসময়টা নির্ধারণ করা হয়েছে এ জন্য যে, এখন কোনো স্কুল কলেজে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পরীক্ষা চলছে না। তাই এ সময়ে যদি রিকশা তুলে দেওয়া যায় তাহলে কয়েকদিন যাত্রীরা যাতায়াত ব্যবস্থায় দুর্ভোগে পড়লেও তেমন ক্ষতির শিকার হবে না। আর এ সময়ের মধ্যেই গণপরিবহন ব্যবস্থাো নিশ্চিত হয়ে যাবে। বিআরটিসির পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা আছে।’
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা শুধুমাত্র প্রধান সড়ক থেকে রিকশা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেই সঙ্গে সকল ফুটপাত দখলমুক্ত রেখে চলাচলের উপযোগী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতে করে রিকশার যাত্রীরা গণপরিবহন এবং পায়ে হেঁটেও গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। প্রথম কয়েকদিন সমস্যা হলেও দ্রুতসময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত গণপরিবহন পাবে যাত্রীরা। আর রিকশা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত মূলত ২০২০ সালের মধ্যে নগরীতে ৬টি কোম্পানির যে ৬ হাজার বাস নামানো হবে সেটির জন্যই। আর এটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে একটি সুশৃঙ্খল এবং স্মার্ট নগরী গঠন করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হবে।
সারাবাংলা/এসএইচ/একে