ঘর সাজানোই যখন প্যাশন
৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৫:১৪
রাজনীন ফারজানা
সিমকি রহমান, একজন গৃহবধূ যিনি নিজেকে একজন বিশেষত্বহীন মানুষ বলে মনে করেন। নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী ডিগ্রী থাকা সত্বেও তিনি সংসার, সন্তান এবং কিছুটা সুযোগ সুবিধার অভাবে চাকরি করতে পারেননি। এটা নিয়ে মাঝেমধ্যে হালকা আক্ষেপ হয়তো কাজ করে তাঁর মাঝে কিন্তু নিজের গৃহকোনটাকে ভালোবেসে সেটার প্রতিই সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছেন তিনি দুই দশকের সংসার জীবনে। ঘরের প্রত্যেকটা আসবাব থেকে শুরু করে খাবার টেবিলের কোস্টারের ব্যবহারেও সিমকি রহমানের রুচি আর যত্নের ছাপ মেলে। তাই তার ঘরে ঢোকা মাত্রই আন্তরিকতা, সৃজনশীলতা আর স্নিগ্ধতার আভায় মন ভরে উঠবে।
২১৫০ বর্গফুটের ডুপ্লেক্স বাসাটি সাজাতে সিমকি রহমান ঐতিহ্য আর আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। মূলত ঘর সাজানোই তাঁর নেশা আর প্রিয়তম শখ। বইপত্র-ম্যাগাজিন পড়ে, টিভি থেকে, মুভি দেখে অথবা কোথাও বেড়াতে গেলে নতুন কিছু দেখে- সবকিছু থেকেই তিনি নিজের ঘর সাজানোর ধারণা নিতে থাকেন। কীভাবে অনুপ্রেরণা পেলেন, জানতে চাইলে তিনি মেলে ধরলেন অতীতের ডালা।
সিমকির শিক্ষিকা মা ছিলেন খুবই গোছানো স্বভাবের আর চাইতেন তার মেয়ে চারটিও ঘর গোছানোর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠুক। তখনকার দিনে সাপ্তাহিক ছুটি থাকতো শনি আর রবিবার। এই দুইদিন তিনি চার মেয়েকে দুইজন দুইজন করে দুই দলে ভাগ করে দিয়ে বলতেন যে দলের সাজানো সবচাইতে ভালো হবে তাদেরকে পুরষ্কৃত করবেন। পুরষ্কারের লোভে সেই ছোটবেলা থেকেই সিমকি রহমানের ঘর সাজানোর নেশার শুরু।
বিয়ের পরে গিয়ে দেখলেন স্বামী আর শাশুড়ি দুজনই খুব গোছানো। বিশেষত তাঁর শাশুড়িকে দেখেছেন সাধারণ গৃহকোনকেও অসাধারণ করে গুছিয়ে তুলতে। যেহেতু চাকরিবাকরি করা হয়ে ওঠেনি তাই মনেপ্রাণে শখের কাজটিকেই আঁকড়ে ধরলেন। তিনি খুব খুশি যে তাঁর স্বামী এবং দুই সন্তানই ঘর গুছিয়ে রাখার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেন এবং অনুপ্রেরণা দেন।
ঘর সাজানোতে তাঁর গভীর আসক্তি। নীচতলাটায় বসার ঘর, খাবারঘর আর রান্নাঘর এবং উপরে তিনটি শোবার ঘর। এছাড়া বারান্দা, বাথরুম, দরজার বাইরের অংশ, ডুপ্লেক্স সিঁড়ির নীচে আর উপরের জায়গাটাকেও তিনি নানাভাবে সাজিয়ে তুলেছেন। তিনি নিজেই কাগজে ছবি এঁকে এঁকে দেখেন ঘরের আসবাবগুলোকে কিভাবে সাজালে সবচাইতে ভালো লাগবে দেখতে। আসবারের আধিক্যের চাইতে তিনি মাথায় রাখেন ঘরে যেন পর্যাপ্ত আলোবাতাস আসে, খোলামেলা ভাব বজায় থাকে আর চারদিকে কিছু না কিছু সবুজের ছোঁয়া যেন অবশ্যই থাকে। তাই তার সারাবাড়ি ভর্তিই প্রচুর গাছ। এক্ষেত্রে তিনি একটি কৌশল অবলম্বন করেন। একসেট গাছ রাখেন ঘরে আরেক সেট রাখেন ছাদে। এক সপ্তাহ পরপর অদলবদল করেন যাতে তারা ঠিকমতো আলোহাওয়া পেয়ে তরতাজা থাকে।
রঙ বাছাই এর ক্ষেত্রে তিনি বিপরীত রঙের মিশ্রন পছন্দ করেন। সেইজন্য দেখা যায় যখন তাঁর সোফা আর কার্পেটের রঙ মেরুন তখন পর্দার রঙ হালকা সোনালি অথবা সোফার রং যখন অফ হোয়াইট তখন পর্দা বদলে যায় মেরুনে। খাবারঘরটা ছোট, তাই একপাশে আয়না রেখেছেন যাতে ঘরটা খোলামেলা লাগে।
ডুপ্লেক্স সিঁড়ির পাশের দেওয়ালজুড়ে রেখেছেন প্রচুর পারিবারিক ছবি। সারা ঘরজুড়েই অবশ্য তাদের পারিবারিক ছবির দেখা পাওয়া যায়। আরেকটা বিষয় মুগ্ধ করবে তা হোল পুরো বাসা জুড়েই বেশ কয়েকটি বই পড়ার জায়গা রেখেছেন তিন। ম্যাগাজিন র্যাকে সাজানো পত্রপত্রিকা আর ছোট ডেস্কে বই। এই বইপত্রও তিনি এক সপ্তাহ পরপর পালটে দেন মূল বুকশেলফ থেকে। এতে করে তাঁর সন্তানদের বই পড়ার অভ্যাস করতে পেরেছেন তিনি।
সিমকি রহমানের ঘরেই যে সৃজনশীলতার ছোঁয়া পাবেন তাই নয়, তার ওয়াশরুমেও পাবেন রুচির ছোঁয়া। সেখানেও ছোট কর্ণার র্যাকে বা জানালার কার্ণিশে রেখেছেন ছোটবড় ডেকোরেশন পিস। যারা ঘর সাজানোকে বেশ ব্যয়বহুল মনে করে এড়িয়ে চলেন তাদের জন্যও সিমকি রহমান একজন অনুপ্রেরণা হতে পারেন। তিনি একবারেই যে সব গুছিয়ে ফেলেছেন তা নয়। এক এক সময় এক একটা বিষয়ের প্ল্যান করেন তারপর সেই পরিকল্পনা বাজেট অনুযায়ী বাস্তবায়ন করেন।
তিনি নিজে দেশে বিদেশে যেখানেই যান একটি ক্রোকারিজ পণ্য আর একটি ঘর সাজানোর জিনিস অবশ্যই সংগ্রহ করেন। কিন্তু যারা সেই সুযোগ পাচ্ছেননা তারাও নিজেদের আশাপাশের মার্কেট খুঁজে খুজেই নিজের রুচিমতো সুন্দর ডেকোরেশন পিস পেয়ে যাবেন।
সিমকি রহমানও ঢাকার সব জায়গা থেকে পছন্দসই উপকরণ সংগ্রহ করেন। সিমকি বলেন, শুধু প্রয়োজন চোখ কান খোলা রাখা আর প্যাশনটাকে জিইয়ে রাখা।
সিমকি রহমানের বাসাটি প্রায় বিশবছরের পুরনো ডিজাইনে বানানো কিন্তু তাঁর চমৎকার রুচির ছোঁয়ায় বাসাটি হয়ে উঠেছে অনন্য। ঘরের প্রতিটি গৃহকোণ থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা ডেকোরেশন পিসেই মিশে আছে একজন সৃজনশীল মানুষের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়া। সিমকি রহমান তাই একজন গৃহবধূ থেকে হয়ে ওঠেন গৃহসজ্জাশিল্পী।
ছবি- হাবিবুর রহমান
সারাবাংলা/ আরএফ/ এসএস