‘খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে ৩২ লাখ মানুষ’
১১ জুলাই ২০১৯ ১০:৫০
ঢাকা: মো.আমজাদ হোসেন (ছদ্মনাম)। বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার কৃষ্ণপুর করিমের খামার গ্রামে। একসময় গ্রামের সবচেয়ে বেশি অর্থ সম্পদের মালিক ছিলেন তিনি। কিন্তু বাড়িতে ছিল না পায়খানা। সকাল হতেই একটি গাছের ডাল দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে হাতে বদনা নিয়ে যেতেন বাঁশঝাড়ে। বাড়ির অন্য সদস্যরা ভোর বেলাই রাস্তার দুই পাশে মলত্যাগ করতেন। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, খোলা জায়গায় না বসলে মলত্যাগ হয় না!
এরকম স্বভাব এবং পায়খানা দেওয়ার সামর্থ্য নেই- দেশের প্রায় ৩২ লাখ মানুষ এখনো খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ করেন। সরকারের নানা উদ্যোগ এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে ধীরে ধীরে এই সংখ্যা কমে আসলেও তা নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, দেশের ২ শতাংশ মানুষ মলত্যাগ করে খোলা আকাশের নিচেই। অন্যদিকে সংস্থাটির অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পল্লী অঞ্চলের ৬ লাখ ২৯ হাজার ৩৯০ জন মানুষ অর্থাৎ ২ দশমিক ২৯ শতাংশ মানুষ খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ করছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে সরকার সাফল্য পেয়েছে। যেসব সামাজিক সূচকে উন্নতি হয়েছে তার মধ্যে স্যানিটেশন অন্যতম। কিন্তু কিছু মানুষ রয়েছেন যারা খোলা স্থানে মলত্যাগে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের বন্দী অবস্থায় মলত্যাগ করানো যায় না। আর অনেক এলাকায় শিশুরা খোলা জায়গায় এই কাজ করেন। এর বাইরে চরাঞ্চলগুলোর বেশিরভাগ বাড়িতেই পায়খানা থাকে না। তবে ধীরে ধীরে এ অবস্থার পরিবর্তন আসছে। এক সময় হয়তো এটি আর থাকবে না।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্ট অব বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্টাটিসটিকস-২০১৮-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালে দেশ খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ করতো নয় দশমিক এক শতাংশ মানুষ। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটি কমে আসছে। ২০০৬ সালে এ হার দাঁড়ায় আট দশমিক নয় শতাংশে। এভাবে ২০০৭ সালে সাত দশমিক দুই শতাংশ, ২০০৮ সালে ছয় দশমিক ছয় শতাংশ, ২০০৯ সালে সাত দশমিক দুই শতাংশ, ২০১০ সালে দুই দশমিক দুই শতাংশ, ২০১১ সালে দুই দশমিক সাত শতাংশ, ২০১২ সালে দুই দশমিক ছয় শতাংশ, ২০১৩ সালে দুই দশমিক দুই শতাংশ, ২০১৪ সালে দুই দশমিক এক শতাংশ, ২০১৫ সালে তিন দশমিক তিন শতাংশ, ২০১৬ সালে দুই দশমিক সাত শতাংশ, ২০১৭ সালে দুই দশমিক ছয় শতাংশ এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে খোলা জায়জায় মলত্যাগ করা মানুষের হার কমে দুই শতাংশে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে এখন স্যানিটারি পায়খানা ব্যবহার করে ৭৮ দশমিক এক শতাংশ মানুষ। এছাড়া অন্যান্য পায়খানা ব্যবহার করে ১৯ দশমিক নয় শতাংশ মানুষ।
এ প্রসঙ্গে মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্টাটিসটিকস অব বাংলাদেশ (এমএসভিএসবি) (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম আশরাফুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ১৯৮০ সাল থেকে দ্বৈত পদ্ধতিতে জন্ম- মৃত্যু, বিবাহ, স্থানান্তর এবং খানার (পরিবারের) বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত নানা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ১৯৮০ সালে মাত্র ১০৩টি নমুনা এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হতো। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে নমুনা এলাকা সংখ্যা ৫’শটিতে উন্নীত করা হয়। এছাড়া জেলা পর্যায়ের তথ্য উপস্থাপনের জন্য ২০০০ সালে একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০০২ সালে নমুনা এলাকা বৃদ্ধি করে এক হাজার করা হয়। বর্তমানে ২০১৮ সালে সারাদেশের ২ হাজার ১২টি নমুনা এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এই নমুনা এলাকার পরিবারের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৯৭ হাজার ২৩৩টি। তাই এই জরিপের তথ্য সঠিক বলা যায়।
এছাড়া গত রোববার প্রকাশ করা হয় কৃষি ও পল্লী পরিসংখ্যান রিপোর্ট-২০১৮ এর প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে দেশের পল্লী এলাকার ২ দশমিক ২৯ শতাংশ মানুষ এখনো খোলা জায়গায় মলত্যাগ করছেন। এর সংখ্যা হচ্ছে, ৬ লাখ ২৯ হাজার ৩৯০ জন। এছাড়া স্যানিটারি পায়খানা ব্যবহার করে ৩২ দশমিক ১২ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ ৮৮ লাখ ২৭ হাজার ৩২১ জন। কাঁচা পায়খানা ব্যবহার করে ২৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ ৭০ লাখ ৮৮ হাজার ৩৯ জন। কূপ বা ইন্দারায় মলত্যাগ করেন সবচেয়ে বেশি- ৩৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ ১ কোটি ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৩ জন মানুষ।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক মো. আকতার হাসান খান সারাবাংলাকে বলেন, এ জরিপটি পরিচালনা করা হয়েছে পল্লী এলাকায়। তাই চরাঞ্চলের বেশিরভাগ বাড়িতেই দেখা গেছে পায়খানা নাই। তারা খোলা জায়গায় মলত্যাগ করেন। এছাড়া একেবারেই হতদরিদ্র কিছু মানুষ রয়েছেন যারা বাঁধের উপর কিংবা কোন খাস জমিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে বসবাস করছেন। তারাতো দুই বেলা দুমুঠো খাবারই যোগার করতে পারেন না ঠিক মতো। তাই তাদের পায়খানা নিয়ে কোন ভাবনাও নেই।
সারাবাংলা/জেজে/এসআই