কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশ্বস্ত করলেও উদ্বিগ্ন পিপলস-এর আমানতকারীরা
১১ জুলাই ২০১৯ ১৫:০৫
ঢাকা : পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফসিএল) অবসায়নে আমানতকারীদের আতঙ্কিত বা উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও আমানতকারীদের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম উদ্বেগ। অবসায়নের (লিকুইডেশন) খবরে প্রতিদিন শত শত গ্রাহক ভিড় করছেন রাজধানীর মতিঝিলে সিটি সেন্টারে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে।
অবসায়নের কারণে এইসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানিক আমানতকারীরা কবে নাগাদ আমানতের টাকা ফেরত পাবেন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা বলতে পারছেন না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আশ্বাস দিয়ে বলা হয়েছে, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতেই মূলত পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন হচ্ছে। এ নিয়ে গ্রাহকদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অবসায়ন হতে যাওয়া এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আটকে পড়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তি আমানতকারীদের ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। অবশিষ্ট ৭০০ কোটি টাকা ৬ হাজার সাধারণ গ্রাহকের।
এদিকে অবসায়নের খবরে পিপলস লিজিংয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। চাকরি হারানোর ভয়ে অনেকই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। গত মঙ্গল ও বুধবার পর পর দুই দিন পিপলস লিজিংয়ের প্রধান কার্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। তবে নিচের সারির কিছু কর্মকর্তাকে পাওয়া গেলেও তারা কথা বলতে রাজি হননি। বরং নিজেদের ভবিষ্য নিয়েই তারা উদ্বিগ্ন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের অনুমতিক্রমে এবং হাইকোর্টের নির্দেশের আলোকে পিপলস লিজিং অবসায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে এখনও আমানতের তুলনায় সম্পদের পরিমাণ বেশি রয়েছে। ফলে আমানতকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক নির্বাহী পরিচালক মো. শাহআলম বলেন, ‘কোম্পানির কয়েকজন পরিচালক বিধি বর্হিভূতভাবে ঋণ নেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি দুর্বল হয়ে পড়ে। যার কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে অবসায়ন করতে হচ্ছে।’
এদিকে বুধবার পিপলস লিজিং কার্যালয়ে কথা হয় নর্দান গ্রুপ অব কোম্পানির উপদেষ্টা শেখ মঞ্জুর মোর্শেদের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কোম্পনির ট্রাস্টি এবং ট্রাস্টি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সুন্দরবন সায়েন্টিফিকের নামে চার কোটি টাকা, ট্রাস্টি আনসার আলীর নামে এক কোটি টাকা, ট্রাস্টি জাবের উল হাসানের নামে ১ কোটি টাকা এবং ট্রাস্টি হালিমা‘র নামে ১ কোটিসহ মোট ৯ কোটি টাকা ডিপোজিট করা হয়েছিল। কিন্তু এসব টাকা আটকে পড়ায় রাজধানীর উত্তরা হাজিক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ ব্যাহত হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডিপোজিটের টাকা তুলে নেওয়ার জন্য আমরা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংককেও চিঠি দিয়েছি। ‘
মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকে পিপলস লিজিংয়ের দুর্বলাবস্থা চললেও ২০১৮ সালে আমরা জানতে পারি। তখন থেকেই টাকা পাওয়ার জন্য আবেদন করি। কিন্তু ডিপোজিটের টাকা ফেরত পাইনি। ’
বিজিআইসির এক নারী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে ১৭ লাখ টাকা হারিয়েছি। তখন ভাবলাম আর শেয়ার ব্যবসা নয়। এবার ব্যাংক টাকা রাখব। এখানে এসেও ধরা খেলাম। ’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৭ সালের শুরুতে পিপলস লিজিংয়ে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ সুদে ৮ লাখ টাকা ডিপোজিট করি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এই রকম দেউলিয়া হয়ে যাবে তা কখনও মাথায় আসেনি। স্বামীর টাকা এখানে ডিপোজিট করেছি। এখন টাকা ফেরত না পেলে আমার সংসার ভেঙে যাবে। ’
অন্যদিকে চট্রগ্রামের আগ্রাবাদ শাখায় আখতার কামাল চৌধুরী নামে এক ব্যাক্তি ৫২ লাখ টাকা ১২ শতাংশ সুদে গত ২ এপ্রিল ডিপোজিট করেন। প্রতিষ্ঠানটির অবসায়নের খবরে তিনি চট্রগ্রাম থেকে পিলস লিজিংয়ের প্রধান কার্যালয় ঢাকায় আসেন। এখানে এসে কোনো ঊর্ধতন কর্মকর্তার দেখা না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন তিনি।
এদিকে প্রতিষ্ঠানটির এমডি সামি হুদার বক্তব্য নেওয়ার জন্য তার অফিসে একাধিকবার গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময় তার মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
অবসায়ন প্রক্রিয়া
বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশ অনুযায়ী পিপলস লিজিংকে অবসায়নের (লিকুইডেশন) অনুমতি দিযেছে সরকার। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির অবসায়নে করণীয় নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আদালতে যাবে। আদালত একজন অবসায়ক (লিকুইডেটর) নিয়োগ দিলে পরবর্তী সময় প্রতিষ্ঠানটি দায় দেনা নিরীক্ষা করা হবে। নিরীক্ষার পর ঠিক হবে পাওনাদারদের মধ্যে কে আগে টাকা ফেরত পাবেন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি কিভাবে তাদের পাওনা টাকা উদ্ধার করবেন তা চূড়ান্ত করা হবে। সব দায়, দেনা ও পাওনা টাকা পরিশোধের পর প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর পিপলস লিজিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে অনুমোদন লাভ করে। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারবাজারে তালিকাভূক্ত হয়। মোট শেয়ারের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৬৮ শতাংশ, উদ্যোক্তাদের ২৩ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে মোট আমানতের পরিমাণ ২ হাজার ৩৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাকি ৭০০ কোটি টাকা রয়েছে ৬ হাজার সাধারণ গ্রাহকদের আমানত। প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৪৮ কোটি টাকা খেলাপিঋণ। খেলাপি ঋণের বড় অংশই নিয়েছে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা।
সারাবাংলা/জিএস/পিটিএম