রেলপথের ৭০ শতাংশ লেভেলক্রসিং অবৈধ, নেই গেটম্যান
২১ জুলাই ২০১৯ ১১:৪৬
ঢাকা: রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকা। রাস্তা পার হলেই রেললাইন। দেখা যায় প্রতি মিনিটে একের পর এক লোকজন পারাপার হলেও এটি কোনো বৈধ রেলক্রসিং নয়। রেললাইনে চোখে পড়ে রক্তের দাগও। স্থানীয়রা জানালেন, প্রতিমাসে রেলে চাপা পড়ে একাধিক মৃত্যু হয় এখানে।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ২ হাজার ৯০০ কিলোমিটার রেলপথে থাকা ৭০ শতাংশ লেভেলক্রসিং অনুমোদনহীন। আর অনুমোদিত ৫০ শতাংশ লেভেলক্রসিংয়ে নেই কোনো গেটম্যান।
মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কা, বর-কনেসহ ৯ জনের মৃত্যু
রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, পূর্ব ও পশ্চিম রেলে ২ হাজার ৫৪১টি লেভেলক্রসিং আছে। তার মধ্যে অনুমোদনহীন লেভেলক্রসিং ১ হাজার ৭৬১টি। প্রায় ৭০ শতাংশ লেভেলক্রসিংই অবৈধ। অন্যদিকে বৈধ ক্রসিংয়ের মাত্র ৪ শ ৬৬টিতে গেটম্যান আছে।
রেলওয়ে কমলাপুর, তেজগাঁও বিমানবন্দর ও টঙ্গি স্টেশন সূত্র জানায়, কমলাপুর থেকে টঙ্গি পযন্ত প্রায় একশ লেভেলক্রসিং আছে। অনেক জায়গায় স্থানীয় লোকজন ইচ্ছেমতো রেললাইনের দুপাশে রাস্তা তৈরি করে পারপারা হয়। এখানে রেলক্রসিং বা সিগনালিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে ঢাকা থেকে টঙ্গি ৩০ কিলোমিটারে ৩১টি বৈধ রেলক্রসিং আছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রেলক্রসিংয়ে দায়িত্বরত গেটম্যানরা তাদের কাজ ফেলে আশেপাশে দোকানপাট খুলেছেন। আবার কেউ দোকান বসিয়ে সেখান থেকে চাঁদা আদায় করেন। রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের শেওড়া রেলক্রসিংয়ে গেটম্যানকে সেখানে দেখা যায়নি। গেটম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন আরেকজন। নাম প্রকাশ না করে স্থানীয় একজন বলেন, গেটম্যান রেলের জায়গায় কয়েকজন হকারকে বসতে দিয়েছেন। তিনি গেছেন তাদের কাছ থেকে ভাড়া তুলতে।
আর একটু সামনে এসেই কুড়িল বিশ্বরোড চৌরাস্তা। এখানে যে লেভেল ক্রসিং, তার আশেপাশে প্রায় বাজার বসে গেছে। লেভেল ক্রসিং পার হওয়া মানুষদের নিয়েই এখানে কেনাবেচা চলছে। এই লেভেলক্রসিংটি অবৈধ। এখানে নেই কোনো সংকেতের ব্যবস্থা। এছাড়া রেলের আইনে রেলপথের দুপাশের ১১ ফুটের মধ্যে কোনো স্থাপনা তৈরি করা যাবে না বলা হলেও শুধু কমলাপুর থেকে টঙ্গি পর্যন্ত হাজারও স্থাপনায় ভরা।
রেললাইন হেঁটে হেঁটে দেখার জনবলও রেলে নিয়োগ দেওয়া আছে। কিন্তু ঢাকার ভেতরেই এভাবে একের পর এক অবৈধ রেলক্রসিং গড়ে তোলা হয়েছে। যার সঠিক তথ্য রেলওয়ের কাছেও নেই। নিয়োগ দেওয়া লোকবলেরও সঠিক তদারকিও হয় না।
রেলওয়ের নতুন মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান জানান, রেলওলর পূর্ব ও পশ্চিম দুটি বিভাগে রেলক্রসিংয়ে মান উন্নয়নে দুটি প্রকল্প চলমান। এছাড়া রয়েছে জনবল সংকট। তবে চলতি বছরে ব্যাপক আকারে জনবল রেলক্রসিংগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক বলেন, ‘দেশের রেললাইনগুলোর দুই পাশে প্রচুর বসতি দেখা যায়। এছাড়া ব্যস্ততম বহু এলাকার ভেতর দিয়ে গেছে রেলাইন। এসব জায়গায় নিচ দিয়ে বা ওভারপাস করে রেললাইন নেওয়ার পদ্ধতি থাকলেও তা করা হয়নি। যে কারণে ঘন ঘন এমন দুর্ঘটনা ঘটছে।’
বিমানবন্দর সড়কের বিউটিফিকেশন কাজে নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভিনাইল ওয়াল্ডের সিইও আবেদ মনসুর জানান, তারা এই সড়কের কাজ করতে এসে দেখেছেন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ অবৈধ রেলক্রসিং ধরে পারাপার হন। প্রতিমাসে বহু মত্যুর ঘটনাও ঘটছে। এ অবস্থায় রেলওয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় তারা কয়েকটি ক্রসিংয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের মাধ্যমে ডিজিটাল রেলক্রসিং বসাবেন। যা ট্রেন আসার বহু আগে বিশেষ আলো ও শব্দ তৈরি করবে এবং দুপাশে চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বাংশ থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ১৭৬ কিলোমিটার রেলপথ। রেলওয়ের বিভিন্ন থানার হিসাবে ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৫ মে পর্যন্ত এই রেলপথে প্রাণ গেছে ২ হাজার ৪ শ ৪৬ জনের। এর অর্ধেকের বেশি প্রাণহানি ঘটে ঢাকায় অবৈধ লেভেলক্রসিংগুলোতে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কিশোরগঞ্জ রেলপথের টঙ্গী-ভৈরব-সরারচর অংশে ২০১৮ সালে এক বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে ১ শ ২০ জনের প্রাণহানি ঘটে। পূর্বাঞ্চল রেলের আখাউড়া সেকশনে ট্রেনে কাটা পড়ে একই সময়ে ৪৬ জনের প্রাণ গেছে।
সারাবাংলা/এসএ/এমআই/জেএডএফ