সিএনজিচালিত অটোরিক্শায় অনিয়ম চরমে, দায় কার?
২২ জুলাই ২০১৯ ০৯:৫৭
ঢাকা: মালিকদের সীমাহীন লোভ, চালকদের বেপরোয়া ভাড়া আদায় এবং কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশ) উদাসীনতার কারণেই সিএনজিচালিত অটোরিকশার ‘রামরাজত্ব’চলছে মেগাসিটি ঢাকায়। রাজধানীতে চলাচল করা রেজিস্ট্রেশনধারী (রুটপারমিট) অটোরিকশার চালকেরা নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন। আর প্রাইভেট (রুটপারমিটহীন) অটোরিকশার চালক-মালিকেরা দাপটে ভাড়ায় চললেও রয়েছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
বেবিট্যাক্সি, টেম্পোসহ টু-স্ট্রোকবিশিষ্ট যানবহান তুলে দিয়ে ২০০১ সালে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালু করার পর প্রথম দুই কিলোমিটারের জন্য ১২ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৫ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সেই সময় সিএনজি’র (কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) দাম কম থাকায় বেঁধে দেওয়া ওই ভাড়া নিয়েও সাধারণ যাত্রীদের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল। তখন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, ঢাকায় সিএনজি স্টেশনের সংখ্যা বাড়লে ভাড়া কমানো হবে।
এরপর সময়ের পরিক্রমায় রাজধানীর মোড়ে মোড়ে বসেছে সিএনজি স্টেশন। তবে স্টেশন বাড়লেও ভাড়া কমানো হয়নি সিএনজিচালিত অটোরিকশার। বরং ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর কেলিব্রেশন (ভাড়া সমন্বয়) করে প্রথম দুই কিলোমিটারের জন্য ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ৪০ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য করা হয় সাড়ে ১২ টাকা। মালিকের জমা নির্ধারণ করা হয় ৯০০ টাকা। এই নির্দেশ অমান্য করলে চালক-মালিকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে।
কিন্তু এখন আর মিটারে চলে না সিএনজিচালিত অটোরিকশা। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকায় চলাচল করা অটোরিকশার ৯৮ শতাংশ চালক চুক্তিতে যাত্রী বহন করেন। মিটার কার্যকর নেই ৬২ শতাংশ অটোরিকশায়।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘যখন যে সরকারই আসুক, সবারই চামড়া মোটা থাকে। তারা সাধারণ মানুষের স্বার্থ নিয়ে খুব একটা ভাবে না। আমরা যতই চিৎকার করি, তারা কর্ণপাত করে না।’
দায়টা কার?
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ঢাকায় এই মুহূর্তে সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা ১৫ হাজার। আর এই ১৫ হাজার অটো রিকশার মালিকানা মাত্র আড়াই হাজার লোকের হাতে। কোনো নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এই আড়াই হাজার মালিক তাদের ইচ্ছামতো জমা নির্ধান করে নিয়েছে। বিআরটিএ বেঁধে দেওয়া ৯০০ টাকার পরিবর্তে চালকদের কাছ থেকে প্রতিদিন ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত জমা নেন। আর এই জমার টাকা তুলতে মিটারের পরিবর্তে চুক্তিতে যেতে যাত্রীদের বাধ্য করে চালকেরা।
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) রাজধানীর কালভার্ট রোডে কথা হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক দুলালের সঙ্গে। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘ভোর ছয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ১০০০ হাজার টাকা। আবার বিকেল ছয়টা থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত ৫০০ টাকা জমা দিতে হয়। এর সাথে সিএনজি’র দাম, সারাদিনের হাতখরচ এবং টুকি-টাকি চাঁদা দেওয়ার পর হাতে কিছু থাকে না। বাধ্য হয়েই আমরা চুক্তিতে চালাই।’
তবে চালকদের এই বক্তব্য পুরোটা সত্য নয় বলে মত দেন সিএনজিচালিত অটোরিকশার কয়েকজন মালিক। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ভোর ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা একদিন। এই ১২ ঘণ্টার জন্য মালিকপক্ষ যদি ১০০০ টাকা জমা নেয়, সেটা খুব বেশি না। সন্ধ্যার পর কেউ যদি অটোরিকশা চালাতে চায়, তাহলে বাড়তি টাকা জমা দিতে হবে।
সিএনজিচালিক অটোরিকশার মালিক রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা সারোয়ার আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে মালিকদের দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। অনেক মালিক আছেন, যারা সরকার বেঁধে দেওয়া ৯০০ টা জমা রাখেন। কিন্তু চালকেরা বাড়তি টাকা রোজগারের জন্য মিটারে না গিয়ে চুক্তিতে যাত্রীবহন করে।’
মিটারে না চালালে সিএনজিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয় জানতে চাইলে পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা সব সময় সতর্ক থাকি। যাত্রীদের কাছ থেকে অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নিই। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ঝামেলা এড়াতে যাত্রীরা নীরব থাকে। চুক্তিতে অটোরিকশায় ওঠার বিষয়টি তারা গোপন রাখে।’
বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলেন, ‘অটোরিকশা নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি ভাড়ার হার, জমা ও মিটার মেনে চলা বাধ্যতামূলক। এই নিয়ম ভাঙলে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতেও চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু মালিক বা চালক নয়, সড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশার নৈরাজ্যের পেছনে কর্তৃপক্ষও অনেকাংশে দায়ী। ২০০১ সালে বেবিট্যাক্সি, টেম্পোসহ টু–স্ট্রোকবিশিষ্ট যানবাহন তুলে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের সিএনজিচালিত অটোরিকশা বরাদ্দের সময় এ খাতে চরম অনিয়ম ও অরাজকতা দেখা যায়। এই অনিয়ম রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে বরং নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ করে দেয় সরকার।
ফলে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যে আড়াই হাজার লোককে ১৫ হাজার রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে, তারাই এখন চড়ামূল্যে মালিকানা হাতবদল করছে। শোরুম থেকে একটি অটোরিকশা ৫ লাখ টাকায় কেনার পর তাতে রেজিস্ট্রেশন নম্বর লাগিয়ে ১৫/১৬ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছেন মালিকেরা। আর এই ১৫/১৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে যারা এ ব্যবসায় নামছেন, তারা ৯০০ টাকা জমার পরিবর্তে চালকদের কাছ থেকে ১৫০০ টাকা জমা রাখছেন।
জানতে চাইলে সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক সারোয়ার আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিছুদিন আগেও ঢাকায় ১৬-১৮ লাখ টাকায় অটোরিকশা বিক্রি হয়েছে। উবার-পাঠাও সার্ভিস চালু হওয়ার পর সিএনজিচালিত অটোরিকশার চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে এখন ১৩-১৫ লাখ টাকায় হাতবদল হচ্ছে।’
সারাবাংলা/এজেড/এমএম