ঢাকা: পদ্মা সেতুতে শিশুদের মাথা লাগবে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরতে থাকা এমন গুজবের জের ধরেই ছেলেধরা সন্দেহে রাজধানীর বাড্ডায় তাসলিমা বেগম রেনুকে পিটিয়ে হত্যা করে একদল দুর্বৃত্ত। আর তাকে হত্যায় বীভৎসতার যে আতঙ্ক তা এখনও উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভেতর থেকে কাটেনি।
মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) বাড্ডায় সরেজমিনে গেলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী সারাবাংলাকে এমন তথ্য জানিয়েছেন।
এর আগে শনিবার (২০ জুলাই) উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের সন্তানের ভর্তির তথ্য নিতে গিয়ে হামলার শিকার হন রেনু। পরে রেনুকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হাসনা হেনা নামে একজন সহকারী শিক্ষক বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে একটি শিশুর কাটা মাথা দেখে এলাকার সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। এর জের ধরেই এখানকার অভিভাবকরা ছেলেধরা সন্দেহে ওই নারীকে পিটিয়ে হত্যা করে।’
বেশ কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা বলেন, এরকম কোনো ঘটনা যাতে আর জীবনে দেখতে না হয়। সেদিনের সময়টা ছিল দুঃস্বপ্ন। এমনদিন কারও জীবনে যাতে না আসে। এখন তো ভয় হচ্ছে, রেনুর মত আমাদেরও না বিপদে পড়তে হয়।
যারা গুজব ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে সবার আগে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান এই শিক্ষকরা। এছাড়া গুজব প্রতিরোধে সরকারকে জোরালো ভূমিকা নেওয়ারও আহ্বান জানান তারা।
এই আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বেই সেদিন রেনুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, বাড্ডা থানা পুলিশ গুজব প্রতিরোধে জনসচেতনা তৈরিতে এলাকায় মাইকিং করছে। তবে অভিভাবক ও শিক্ষকদের দাবি তাদের শিশুরা এখনও আতঙ্কে সময় পার করছে।
উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল গফুর বলেন, ‘স্কুলে মোট ৬৭৯ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ সব সময় উপস্থিত থাকত। কিন্তু সেদিনের ঘটনার পর ক্লাসে উপস্থিতির হার কমে গেছে। ঘটনার পরদিন শিক্ষার্থী উপস্থিতি ছিল মাত্র ৫ জন। গতকাল উপস্থিত ছিল ৩১৯ জন। আর আজ উপস্থিত রয়েছে ৪০২ জন। শিশুদের আতঙ্ক এখনও কাটেনি। সবাইকে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। ’
ওই দিনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘গণপিটুনির সময় ক্লাসের সকল শিশু আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এক জায়গায় জড়ো হয়ে কান্না শুরু করে তারা। শিক্ষকরাও এ সময় শিশুদের বোঝানোর কাজে ব্যস্ত থাকে। সব মিলিয়ে ওইদিন একটা ভীতিকর পরিস্থিতি ছিল।’
স্কুলের আয়া জান্নাত আরা বলেন, ‘স্কুলে দারোয়ান থাকলে ওইদিনের ঘটনাটি নাও ঘটতে পারত। ’ এছাড়াও একজন সহকারী শিক্ষক বলেন, ‘শহরের এরকম একটি স্কুলে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে না তা কি করে হয়। আবার নেই কোনো সিকিউরিটি গার্ড। ’ তিনি অবিলম্বে বিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান।
সেদিন যা ঘটেছিল
বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক জিয়াউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার দিন সকাল ৭টা ৫৫ মিনিটে বিদ্যালয়ের মাঠে শিক্ষার্থীদের পিটি শেষ হয়। এরপর সবাই ক্লাসে যায়। প্র্রধান শিক্ষকের কক্ষের পাশে শিক্ষকদের বিশ্রাম কক্ষে হাজিরা খাতা নিতে গিয়ে দেখি, তিনজন নারী অভিভাবক আরেক নারীকে নিয়ে আসছে। তাদের অভিযোগ, তিনি নাকি উল্টাপাল্টা কি বলছেন। তাকে অনেকেই ছেলেধরা সন্দেহ করছে। তাই ওনাকে ম্যাডামের কক্ষে নিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি বলতে থাকেন, ‘এরপর চার নারীকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে আমি নিয়ে যাই। ম্যাডাম ওনাকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার বাড়ি কোথায়, আপনি কি এর আগে আমাদের কাছে এসেছিলেন? আপনার কারও মোবাইল নম্বর দেন আমরা ফোন করি। উনি কোনো তথ্য না দেওয়ায় একটা সাদা কাগজে উনার নাম-ঠিকানা লিখতে বলেন ম্যাডাম। উনি নাম-ঠিকানা লিখছিলেন। এরই মধ্যে গফুর নামে আরেক সহকারী শিক্ষক এসে বলেন, শত শত লোক স্কুলে প্রবেশ করেছে। এই মহিলা নাকি ছেলেধরা। তখন উপস্থিত সবাই ওই মহিলাকে বাঁচানোর চেষ্টা করি, কিন্তু তার আগেই সকলকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে উনাকে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামিয়ে নিয়ে যায়। আমরা দুইতলা থেকে দেখলাম তাকে শুধু মারছে।’
জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমরা যে নিচে যাব তারও কোনো উপায় ছিল না। এরই মধ্যে ম্যাডাম পুলিশকে ফোন করেন। প্রত্যেকটা শ্রেণিকক্ষে শিশু শিক্ষার্থীরা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এ সময় ওইসব শিক্ষার্থীদের বাঁচানোটাই ছিল বড় দায়। ’
যে তিন নারী অভিভাবক রেনুকে ম্যাডামের কক্ষে নিয়ে যান তাদের একজন আকলিমা বেগম। ২৮৭ আলীর মোড়ে স্বামী রিকশাচালক মো. মিরাজের সাথে এক সন্তান নিয়ে বসবাস করেন তিনি। তার বাসায় গেলে আকলিমা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা রেনুকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে নিয়ে গিয়েছি নিরাপত্তার জন্যই। কিন্তু সেখান থেকে উত্তেজিত জনতা টেনে হিচঁড়ে নিচে নামিয়ে আনে। হাজার হাজার লোক কি করছে সেটাই বোঝা যায়নি। রেনু যে দুই ঠিকানার কথা বলেছিল, সেটাই যে ঠিক ছিল তা কেউ জানত না। পুলিশ ডেকেছিল থানায়। যা ঘটেছিল তাই বলেছি।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহনাজ রহমান বলেন, ‘কেচিগেটের তালা ভেঙে দ্বিতীয় তলায় আমার কক্ষে উঠে আসে বহিরাগতরা। তারা আমাদের সবাইকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। ভাঙা তালা থানায় জমা দেওয়া হয়েছে।’
পুলিশ যা বলছে
বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো গুজবের জের ধরেই রেনুকে দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। পুলিশ ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এরই মধ্যে গুজব ছড়িয়ে আবারও কেউ যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সেজন্য আমরা এলাকায় মাইকিং করেছি। এছাড়া এলাকার মানুষদের সাথেও পুলিশ যোগাযোগ রাখছে যেন যেকোনো পরিস্থিতি সবাই মিলে মোকাবিলা করা যায়।
বাড্ডা থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) ইয়াছিন গাজি সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডার স্বাধীনতা স্মরণির আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে ৫/৭ জন লোক তাসলিমা বেগম রেনুকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে টেনে হিঁচড়ে নামায়। এরপর তারা রেনু বেগমকে উপর্যুপরি মারতে থাকে। মাঝখানে মারধর থামলেও ওই আজাদই এলাকার হৃদয় নামের একজনকে নিয়ে রেনুর মাথা বিদ্যালয়ের দেয়ালে জোড়ে ধাক্কা দেয়। এতে তার মাথা থেঁতলে যায়। এরপর আবারও তাকে মারধর করা হয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ আসে। তখনও বেশ কয়েকজন রেনুকে লাথি মারছিল। পরে পুলিশ মুমূর্ষ অবস্থায় রেনুকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে সেদিন লোকজন একত্রিত হয় এবং রেনুকে পিটিয়ে হত্যা করে। ওই ঘটনায় আজাদ ছাড়া আরও ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে জাফর আহমেদ ছিল রেনুকে টেনে হিঁচড়ে নামানোর একজন। বাকিরা তাকে মারধর করেছে।’
আজাদ সম্পর্কে পুলিশ পরিদর্শক বলেন, ‘আজাদ স্বাধীনতা স্মরণিতে থাকেন। তিনি ওই এলাকার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলাও রয়েছে। ওই এলাকায় কেউ বাড়ি নির্মাণ করতে গেলে আজাদ চাঁদাবাজি করতো। এছাড়াও সে নানান অপরাধে জড়িত ছিল।’
বাড্ডা থানা পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার সকালে গ্রেফতার হওয়া ওয়াসিম (১৪) পুলিশকে জানায়, ছেলেধরাকে মারধর করা হচ্ছে শুনে মুরগি বিক্রি বন্ধ রেখে ভির ঠেলে অনেক কষ্টে সেখানে যায় এবং রেনুকে লাথি মারে। রেনুকে হত্যার ঘটনায় আরও যারা জড়িত তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম