জনতার মুখোমুখি: নগরবাসীর প্রশ্নবাণে জর্জরিত মেয়র নাছির
২৫ জুলাই ২০১৯ ১৯:১৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: দায়িত্ব গ্রহণের চার বছর পূর্তিতে ‘জনতার মুখোমুখি’ হয়ে নালার আবর্জনা নিয়মিত অপসারণ না করা, যানজট, চাঁদাবাজি, ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যসহ বিভিন্ন নাগরিক দুর্ভোগ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। এসব প্রশ্নের উত্তরে কখনো অতীতের অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের ওপর দায় চাপিয়েছেন, কখনো প্রশ্নকর্তাকেই তার দায়িত্বের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মেয়র। অপপ্রচারের ভয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া, নগরবাসীর কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ এবং প্রত্যাশিত সহযোগিতা না পাওয়ার কথাও বলেছেন মেয়র।
বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর এস এ খালেদ সড়কের একটি কমিউনিটি সেন্টারে ‘জনতার মুখোমুখি মেয়র’ অনুষ্ঠানে সরাসরি বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন মেয়র। এসময় স্থানীয় জামালখান ওয়ার্ড ও আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের কয়েকজন উপস্থিত থেকে মেয়রকে সরাসরি প্রশ্ন করেন।
নালা-নর্দমার আবর্জনায় পানি আটকে জলাবদ্ধতার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, ‘চট্টগ্রামের উন্নয়ন অতীতে সব পরিকল্পিতভাবে হয়েছে সেটা বলতে পারছি না। অপরকল্পিত নগরায়নের কুপ্রভাব আমরা ভোগ করছি। অপরিপূর্ণ ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের কাজে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। নগরবাসী সচেতন ও দায়িত্বশীল হলে সমস্যা ধারাবাহিকভাবে সমাধান সম্ভব হবে।’
ফারজানা নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা মেয়রকে বলেন, “জামালখান বাই লেনের নালায় মাটি ও পলিথিনের স্তুপ। গত সপ্তাহে কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনকে বলেছি। তিনি বলেছেন, এটা আমাদের নয় সিডিএ’র কাজ। সিডিএ তে বলেছি, তারা বলছে এটা সিটি করপোরেশন করবে। সমাধান কী?”
জবাবে মেয়র নাছির বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল নগরবাসী যত দ্রুত জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পায়। তাই সিডিএ যখন জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প নেয় তখন বলেছি, শতভাগের বেশি সহযোগিতা করবো। সিডিএকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে ও মৌখিকভাবে বলেছি, কোন ৩০২ কিলোমিটার সেকেন্ডারি নালার কাজ তারা করবে সেটা জানাতে। তাহলে বাকিগুলো আমরা করবো। একটা প্রকল্প এক প্রতিষ্ঠান নিলে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। ওভারলেপিং এর সুযোগ নেই।’
‘সিডিএর নতুন চেয়ারম্যান ও সেনাবাহিনী দ্রুত তালিকা দেবেন বলে জানিয়েছেন। উনারা কিছু কাজ শুরু করেছেন। সিডিএ’র সাথে যোগাযোগ করে আপনার এলাকার সমস্যা সমাধান করব।’
নগরীর জামালখানে সড়কের ফুটপাতে বসা অবৈধ বাজার থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনেন স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা। জামালখান সিঁড়ির গোড়া এলাকার বাসিন্দা ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এটিএম আহসানউল্লাহ খোকন বলেন, ‘সিঁড়ির গোড়ায় সকালে অবৈধ বাজার বসে। সেখানে চাঁদাবাজি চলে। ভ্যান থেকে ৪০০, মাছ বিক্রেতার কাছ থেকে ৩০০ এবং ঝুড়ি নিয়ে যারা বিক্রি করে তাদের কাছ থেকে ১৫০ টাকা নেওয়া হয়। পুলিশ একভাগ, সিটি করপোরেশনের লোকজন একভাগ এবং নেতা এক ভাগ নেয়।’
জবাবে মেয়র নাছির বলেন, ‘আপনি সিটি করপোরেশনের বিষয়ে ঢালাওভাবে বললে তো হবে না। কে নেয়, নাম জানেন? নাম জানলে বলেন।’ উত্তরে আহসানউল্লাহ খোকন বলেন, ‘পরিচ্ছন্নকর্মীরা টাকা তোলে।’
এরপর মেয়র বলেন, ‘যদি আপনার অভিযোগ সত্যি হয় তাহলে তাদের আমি ডাকব। ব্যবস্থা নেব। আপনিও তো এলাকার নেতা। আপনার কী ভূমিকা আছে। নগরীতে যত বাজার প্রয়োজন তত নেই। আপনি না করলেও এখানে অনেকে হয়ত বাজার করেন। তবে অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নেব।’
নগরীর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাংবাদিক প্রীতম দাশ বলেন, ‘নগরীর জামলাখানসহ বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসীরা দিন-দুপুরে প্রকাশ্যে ছিনতাই-চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এই অপরাধীদের অনেককে মেয়রের নাম ব্যবহার করতে দেখা যায়। তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা?’
জবাবে মেয়র বলেন, ‘নাগরিক হিসেবে আপনাদের দায়িত্ব রয়েছে। আপনি সেসব অপরাধীরে বিরুদ্ধে নিকটস্থ থানায় অভিযোগ করেছেন কিনা? কোনোসময় আমাকে (মেয়র) বা কাউন্সিলরকে জানিয়েছেন কিনা? অপরাধী যেই হোক তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
যানজট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, ‘এটা কোনো পরিকল্পিত নগর নয়। হলে এই নগরের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতো। কোন ওয়ার্ডে কত স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল থাকবে সেভাবে নির্ধারিত থাকতো। এভাবে যানজটসহ নানা সমস্যা হতো না।’
অনুষ্ঠানে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির চিত্রও তুলে ধরেন মেয়র। তিনি বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে আমাদের আদায় ৪০ শতাংশ। মানে ৫৯ কোটি টাকা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ভর্তুকি মোট ৫৪ কোটি টাকা। হাতে থাকে ৫ কোটি। মাসে বেতন-ভাতা দিতে হয় ২০ কোটি টাকা। বছরে প্রশাসনিক ব্যয় আসে ২৬০ কোটি টাকা। নগরবাসীর কাছ থেকে যে সমর্থন পাওয়া দরকার তা পাই না।’
যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ বন্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। নিজে দাঁড়িয়ে জরিমানাও করেছিলাম। কিন্তু সে সময় আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল- আমি নাকি নগর কিনে ফেলেছি। নগরীর শাসক হয়ে গেছি। মার্শাল ল’ জারি করেছি কিনা? এই ধরনের অপপ্রচারের কারণে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপকারীরে বিরুদ্ধে আপাতত ব্যবস্থা নেওয়া বন্ধ রয়েছে।”
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র হাসান মাহমুদ হাসনী, জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন এবং মহিলা কাউন্সিলর মনোয়ারা বেগম মনি ছিলেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। ওই বছরের ২৬ জুলাই তিনি মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
সারাবাংলা/আরডি/এমও