Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শো-অফ নয়, দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ হোক নিখাদ!


৩০ জুলাই ২০১৯ ১৯:০১

মাতৃভূমিকে ভালোবাসেন না এমন মানুষ কি আদৌ আছেন? রাষ্ট্রব্যবস্থা, অনিয়ম, ন্যূনতম অধিকারটুকুও না পাওয়াসহ হাজারো হতাশা থাকতেই পারে, কিন্তু দিনশেষে দেশকে ভালোবাসেন না এমন মানুষ পাওয়া দুস্কর।

এইতো দুই বছর আগের কথা, সুদূর ইউরোপের অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার পথে হাঁটছি, জাতিসংঘের একটা সেশনে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সেশনে যাব সংবাদ সংগ্রহে। হঠাৎ খেয়াল করলাম এক কিশোর আমাদের (ঢাকা থেকে যাওয়া সাংবাদিকদের) ফলো করছে। কিছু একটা বলতে চাইছে। কাছে ডেকে বললাম, ‘কিছু বলবেন?’

বিজ্ঞাপন

ছেলেটি কথা বলা শুরু করল। আমরাও শুনতে লাগলাম। তার মূল কথা ছিল- কোনো এক এলাকায় একই দলে দ্বন্দ্ব প্রকট হওয়ায় দেশ থেকে স্বপরিবারে চলে আসতে হয়েছে তাদের।ছেলেটি এখন ভিয়েনাতেই পড়ালেখা করেন। নিজের কথাগুলো যতটুকু সম্ভব গুছিয়ে বলছিল সে। আর একটু একটু করে তার চোখের কোণে জমতে শুরু করেছিল অভিমানের অশ্রু। বোঝাই যাচ্ছিল অনেকদিন ধরে জগদ্বল পাথরের মত এতগুলো কথা বয়ে বেড়াচ্ছিল ছোট্ট এই ছেলেটি। এত কষ্টের মধ্যেও সে সবার সঙ্গে নিজ দেশের ভালো ভালো গল্প করে। যখন তার দেশ নিয়ে কেউ বাজে কথা বলে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এমন একজন ত্যাগী মানুষও ভুল করেন না দেশপ্রেম বহিঃপ্রকাশে। হাজারও ক্ষত মনের গহীনে রেখে ঠিকই দেশকে উঁচুতে তুলে ধরেন অন্যের সামনে।

আবার আমাদের ভিন্ন চিত্রটাও দেখতে হয়। হতভম্ব হয়ে দেখতে হয় সেসব দৃশ্য। যেমন ধরুন, প্রিয়া সাহার ঘটনাটিই। বাংলাদেশি পরিচয়ে সংখ্যালঘু হিসেবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমনটা উল্লেখ করে বিচার দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে! ধরেই নিলাম তার অভিযোগ সত্য। কিন্তু আমাকে একটু বলবেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিভাবে তাকে সাহায্য করবেন? কোন অধিকারে তিনি অন্য আরেকটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবেন? হলোও তাই- প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাত্তাই দিলেন না! সারাবিশ্বের কাছে বাংলাদেশের লজ্জার নাক কাটিয়ে কি লাভ হলো তার!

বিজ্ঞাপন

প্রিয়া সাহা একা নন, দায়িত্বশীল অনেক ব্যক্তিকে দেখেছি প্রবাসে যাওয়ার পর দেশ নিয়ে বাজে মন্তব্য করেই চলেছেন। অনেকে আবার অনৈতিকভাবে রাজনৈতিক আশ্রয়কে জাস্টিফাই করতে প্রতিনিয়ত বিশ্বের কাছে দেশকে ছোট করে আসছেন। সমালোচনা হতেই পারে। তবে সেটা হতে হবে গঠনমূলক, তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণ নির্ভর।আবার অনেকে দেশের বিভিন্ন গুজবকে কেন্দ্র করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের মতামত দিয়ে বেড়াচ্ছেন। কখনও কখনও অকথ্য ভাষায় চলছে গালিগালাজও। যেমন ধরুন- এইতো সেদিনের ভাইরাল স্টার ‘সেফুদা’র কথাই! এ কেমন দেশপ্রেম?

অল্প কিছুদিন আগেও ভারতীয় এক বন্ধু বলছিল ঢাকার রাস্তায় তুমুল যানজটের কথা। হাসতে হাসতে বলছিলাম, ‘এটাই আমাদের রাজধানীর বিউটি’। পরক্ষণেই বললাম, দেখ এদিকে মেট্রোরেল, ওখানে ওভারব্রিজ, বাইপাস, হাইস্পিড ব্লা ব্লা… আমরা তুমুল একটা কর্মযজ্ঞের মধ্যে আছি। বুঝলা? তাই এই যানজটের সংকটটাও এখন প্রকট। সামনে সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘হয়তো সত্যি সত্যি ঠিক হয়ে যাবে একদিন। কিন্তু এখন কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করলে সেটা আদৌ কি ঠিক করা যাবে?

জাতীয় ক্রিকেট দলের ওপেনার তামিমকে কেন ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফর্মে বলতে হবে, ‘মাশরাফিকে নিয়ে মন্তব্য করার আগে একবার আপনারা কেন চিন্তা করেন না- এই দেশের ক্রিকেটের পেছনে তার অবদান কতটুকু?’ কেন এইটুকু দায়িত্ববোধ আমাদের থাকবে না? কেন তামিমকে সাফাই গাইতে হবে আমাদের হয়ে? তাও বিশ্বকাপের প্রেস ব্রিফিংয়ের মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে।

বাংলাদেশের সরকার দলীয় সাংসদ, বিশ্ব ইতিহাসে প্রথমবার কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি একইসাথে তার জাতীয় ক্রিকেট দলেরও কান্ডারি; জীবন্ত কিংবদন্তি। হয়ত যথার্থ ছন্দে নেই। কিন্তু তাতেও কি আমরা পারি ঢালাও নেতিবাচক প্রচারণা করতে? এসব করে আমরা কি আমাদের সম্মান বাড়াচ্ছি, না কমাচ্ছি। এ কেমন দেশপ্রেম? একবার ভাবুনতো মাশরাফি যখন ফেসবুকটা খোলেন তখন তার কেমন লাগে! যেই দেশের ক্রিকেটের জন্য জীবনের সেরা সময়টা তিনি বিনিয়োগ করলেন, তার বিনিময়ে এই কি তার প্রাপ্য?

আমরা এমন আচরণ কেন করছি? আমরা তো কোনো অর্থেই এমন অকৃতজ্ঞ ছিলাম না কোনোদিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার পর আমরা আরও বেশি আবেগী হয়ে উঠেছি। যখন তখন সাত-পাঁচ না ভেবেই বয়কট খেলায় মেতে উঠেছি। ঈদের আগে দেখলাম কোনো একটা স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের দোকানে অভিযান, ম্যাজিস্ট্রেটের জরিমানা। সেই থেকে শুরু হলো পুরো প্রতিষ্ঠানকে বয়কট। পরে জানা গেলো, ট্যাগিংয়ে ভুল। কোটি মানুষের পোশাক বিতরণে একটা ট্যাগিং ভুল তো হতেই পারে। শাস্তিও মিলল চটজলদি!এর দায় কি পুরো প্রতিষ্ঠানের? সেই প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ৬৫ হাজার গ্রামীণ তৃণমূল নারীর কথা কেউ একবারও ভেবেছেন!পুরো প্রতিষ্ঠান বয়কটের খবরে তাদের মুখ কতটা পাংশু হয়ে উঠেছে ঈদের ঠিক আগে। একটিবারও কি কেউ ভেবেছেন ওই শ্রমজীবী মানুষের কথা! যাদের কাছে সেলাই-ফুরাই করে দু-মুঠো অন্ন, জীবন-যাপনে একটু স্বস্তিই মুখ্য! কিন্তু আমাদের জন্য সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের সুশীল ভাব বজায় রাখতে স্ট্যাটাসটাই্ মুখ্য!এ কেমন দেশপ্রেম!

আমরা শুধুই অযাচিত একটা শো-অফের রাজত্বে বাস করছি! মুখে বলছি এক, কিন্তু করছি আরেক! মুখ আর মুখোশে আমাদের যোজন যোজন দূরত্ব! সোস্যাল মিডিয়ার স্ট্যাটাসে নারীর অধিকার নিয়ে তুবড়ি ছুটিয়ে ফেলছি। কিন্তু নিজের ঘরে গিয়েই সেই চিরায়ত ন্যাক্কারজনক পুরুষতান্ত্রিকতায় ফিরে যাচ্ছি!

মুম্বাইয়ের রাস্তায় কোনো এক শুভ্র কাকডাকা সকালে ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়েছি; পুরো রাস্তা খালি, কোথাও ট্রাফিক পুলিশের টিকিটিও নেই! কিন্তু লাল বাতি পোস্টে হার্ড ব্রেক চেপে দাঁড়িয়ে পড়ছে ট্যাক্সি, সাথে দু-চারটা মোটরবাইকও! দিব্যি চলে যেতে পারতেন ওপারে! ভাবছেন জরিমানার ভয়! না। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা!আমার কাছে এটাই দেশপ্রেমের যথার্থ বর্হিঃপ্রকাশ!

কতো লিখব, আর কতো! মূল্যবোধের এই অবক্ষয়ে এই উদাসীন আচরণ পরিবর্তনে কি আদৌ কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আছে!বাদ দিলাম। এটা তো আর ওয়েলফেয়ার স্টেট না। আমরা বা আমাদের পরিবার কতটুকু সময় ব্যয় করছেন নতুন প্রজন্মকে সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে!

বাংলাদেশকে ঘিরে, আমার মাকে ঘিরে আমি প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই আবেগি। কিন্তু স্যোসাশ মিডিয়ায় আমাদের এই কাণ্ডগুলো আমাকে সত্যিই হতাশ করে। নির্বাক করে। লজ্জিত করে। – আসলে দেশপ্রেম নিয়ে হিপোক্রেসি সহ্য করা কঠিন।

আসুন শো অফের দেশপ্রেম বাদ দিয়ে দেশকে সত্যি সত্যি ভালোবাসি। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনারা কতজন সত্যি সত্যি মাকে বলেছেন- তোমাকে ‘ভালোবাসি’। অনেকেই হয়তো বলেননি অযাচিত লজ্জায়। কিন্তু কেউ কি মাকে এতটুকু কম ভালোবাসেন? কিছু জিনিস দেখাতে হয় না। কিছু জিনিস থাকুক না উপলব্ধিতেই…আমাদের দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশটাও এখন থেকে যথার্থ হোক…

রাফে সাদনান আদেল

যোগাযোগকর্মী, কলামিস্ট

[মত-দ্বিমতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব]

দেশপ্রেম শো-অফ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর