Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উত্তরায় বেপরোয়া কিশোর গ্যাং, জামিনে বেরিয়ে ফের দৌরাত্ম্য


৩১ জুলাই ২০১৯ ০৮:০০

ঢাকা: রাজধানীর  উত্তরা, আবদুল্লাহপুর, তুরাগ, দক্ষিণখান ও উত্তরখানসহ আশপাশের এলাকায় বর্তমানে প্রায় ২৪টি কিশোর গ্যাং আধিপত্য বিস্তার করছে, যারা দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। গত তিনমাসে এই এলাকা থেকে কমপক্ষে ২৯ জন কিশোর অপরাধীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু বারবার গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলেও  স্থানীয়  প্রভাবশালী মহল তাদের ছাড়িয়ে আনে। যে কারণে এসব কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ।কিশোর গ্যাংয়ের সদ্যদের অপকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে র‌্যাব-১০  এর অধিনায়ক  সারওয়ার-বিন-কাশেম সারাবাংলাকে বলেন, উত্তরা ও এর আশপাশের এলাকায় যেসব কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে তারা অনেকটাই বেপরোয়া।  তাদের নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে। এখন পর্যন্ত এলাকার বিভিন্ন গ্যাং গ্রুপের  ২৯ সদস্যকে  গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু  যেভাবে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে তাতে  এখন পর্যন্ত যতটুকু অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে বা গ্রেফতার হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। এলাকার বাসিন্দারা যেদিন থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে সেদিনই কিশোর গ্যাং কমেছে বলে মনে করব আমরা।

বিজ্ঞাপন

র‌্যাব-১ এর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের দায়িত্ব থাকে অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা। তাই আমরা গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো পর্যন্ত কাজ করে থাকি। কিন্তু তারা যখন জামিনে বেরিয়ে যায় তখন আর আমাদের কিছু করার থাকে না। বেশিরভাগ সময় এসবে রাজনৈতিক প্রভাব থাকে। আবার কখনও আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে তারা বেরিয়ে যায়। এক্ষেত্রে আরও কঠোর নজরদারি  দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাং মূলত পরিবারের দায়িত্ব-হীনতার কারণে গড়ে উঠে। কারণ সন্তান কখন কার সঙ্গে মিশে, কোথায় কি করে সে সে খোঁজ না নেওয়ার ফলেই এ কিশোর গ্যাংয়ের উত্তপ্তি ঘটে। তাই শুধু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর নির্ভর না করে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবেও অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। তা না হলে এটি আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠবে। তখন এদের নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। এজন্য পরিবারের পাশাপাশি এলাকা ভিত্তিক যে সামাজিক সংগঠন থাকে তাদেরকেও সোচ্চার হতে হবে।’


উত্তরা জোনের উপ-পুলিশ (ডিসি) কমিশনার নাবিদ কামাল শৈবাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ম্প্রতি কিশোর খুন হওয়ার ঘটনার পর আমরা অনেক বেশি সতর্ক অবস্থানে আছি। যাতে আর এ ধরণের ঘটনা ঘটতে না পারে এবং তারা যেনো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেটি নিয়ে আমাদের সদস্যরা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে স্কুল কলেজের কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবকদেরকেও নিজেদের সন্তানদের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির ওপর গুরত্ব দেওয়া হয়েছে।’

কিশোর গ্যাং কিভাবে গড়ে উঠে

উত্তরার আযমপুর, বামনার টেক, নলভোগ, রানাভোলা, নয়া নগর, কামার পাড়া, রুস্তমপুর, ১২ নম্বর সেক্টর পার্ক, মোল্লা পাড়া, নোয়া পাড়া, কাজীবাড়ি, চালাবনসহ বেশ কিছু  এলাকার বাসিন্দারাও সঙ্গে  এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানার এসব কিশোর গ্যাং শুরুতে কয়েকদিন সমবয়সি কিশোররা আড্ডা দেয় এলাকার অলিগলিতে। যাদের বয়স থাকে ১৫ থেকে ১৮ বছর কিংবা তারও একটু বেশি। এসময় তারা স্থানীয় স্কুল কলেজ-গামী মেয়েদেরকে বিভিন্নভাবে ইভটিজিং করে। সেই সঙ্গে একে অপরের সঙ্গে বিভিন্ন সিনেমা-নাটক গল্পের আদলে ফ্যাশনের প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়। আর এভাবে তাদের মধ্যে একটা সখ্যতা গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে তারা জড়িয়ে পড়ে নেশার আসক্তিতে। সেই সঙ্গে শুরু করে চুরি-ছিনতাই।   এক পর্যায়ে জড়িয়ে পড়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে। শুরু হয়  অন্য গ্রুপের সঙ্গে নানা দ্বন্দ্ব। এসব দ্বন্দ্বের মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য থাকে রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিতে পড়া। আর রাজনৈতিক নেতাদের দলে ভিড়তে পারলেই তারা এলাকায় হিরো বনে যায়। আর এভাবেই গড়ে উঠে  এলাকা ও গলি ভিত্তিক কিশোর গ্যাং।

 কিশোর গ্যাংয়ের  অপকর্মের শিকার ওইসব এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কিছু দিন পর পর অভিযান চালিয়ে গ্যাংয়ের সদস্যদেরকে গ্রেফতার করলেও তারা রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা আইনের ফাঁক গলিয়ে জামিনে বেরিয়ে ফের গ্যাং তৈরি করে। আবার  গ্রেফতার হওয়া সদস্যদের অনুপস্থিতিতে দুর্বল গ্রুপের অন্য সদস্যরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এতে দিনকে দিনকে আতঙ্ক বাড়ছে এসব এলাকায়। এসব কিশোরদের অপরাধের  বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়ালে বা প্রতিবাদ করলে হয়রানির শিকারও হতে হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরা, আবদুল্যাহপুর, তুরাগ, দক্ষিণখান ও উত্তরখানসহ আশপাশের এলাকায় প্রায় ২৪টি কিশোর গ্যাং আধিপত্য বিস্তার করছে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যে স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি কাজ করছে বলে জানিয়েছেন  স্থানীয়রা।

না প্রকাশে অনিচ্ছুক  ‍উত্তরার  কয়েকজন বাসিন্দা জানান,  উত্তরা ও তার আশপাশের এলাকায় বর্তমানে এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্লাক রোজ, রনো, কে নাইন, ফিফটিন গ্রুপ, ডিসকো বয়েস, নাইনস্টার, নাইন এম এম বয়েজ, পোটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, নাইন স্টার, থ্রী গোল, দ্যা বস, চাবি রাজু ও পল্টিবাজ নামে ২৪টি গ্রুপ সক্রিয়। যাতের তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রয়েছে। এর বাইরেও ছোটখাটো আরও বেশ কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। যেগুলো এখনো ততোটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।

উত্তরার ১৯ নাম্বার সেক্টরের স্থানীয় একজন মুদি দোকানী সারাবাংলাকে বলেন, কিশোর গ্যাংগুলোর অত্যাচারে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। বিশেষ করে ডিসকো বয়েজ, নাইন স্টার এবং এম বয়েজ নামে যে গ্রুপ গুলো আছে তারা খুব বেপরোয়া। কতবার পুলিশ-র‌্যাব তাদেরকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু কি হয় তাতে। দুদিন পর জামিনে বেরিয়ে আসে। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে কেউ তেমন প্রতিবাদ করে না। কেউ প্রতিবাদ করলেও লাঞ্চনার শিকার হতে হয় ।

অপর একজন চা দোকানদার সারাবাংলাকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের কারো নাম যদি আমি বলি আর তারা যদি সেটা জানতে পারে তাহলে তো দোকানই করতে পারব না। স্থানীয় তাদেরকে রাজনৈতিক নেতারা তাদের ব্যবহার করে। আবার পুলিশও ব্যবহার করে। তাই তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে নিজের ক্ষতি করা।

কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দ্বারা অতিষ্ঠ হলেও তেমন প্রতিকার পাচ্ছেন না বলে জানান তারা।

দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, নিজের দুইটা ছেলে। তারা একজন নাইনে আরেকজন সেভেনে পড়ে। স্কুলে পাঠানোর পর বাসায় আসা পর্যন্ত চিন্তায় থাকি কখন কার সাথে মিশে। চারদিকে বখাটের দলবল সারাক্ষণ আড্ডা মারে। তাই এদের থেকে নিজের ছেলেদেরকে নিরাপদ রাখতে সব সময় চিন্তিত থাকি। তবে এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।

উত্তরা কিশোর গ্যাং গ্রেফতার বেপরোয়া

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর