Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চিকিৎসা ব্যয়ে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ, ৫ বছরে খরচ বেড়েছে ২৭ ভাগ


৩১ জুলাই ২০১৯ ১০:২৭

ঢাকা: বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মোছা. নাসরিন বেগম (ছদ্ম নাম)। যেকোনো অসুস্থতায় চিকিৎসা নিতে তিনি এখন চলে যান দেশের বাইরে। থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুর না হলেও অন্তত প্রতিবেশী ভারতের কলকাতায় গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে আসেন। দেশের এত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল রেখে কেন তিনি অসুস্থ হলেই ছুটে যান দেশের বাইরে? নাসরিনের উত্তর, দেশের চিকিৎসক ও চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থাপনায় আস্থা নেই তার। নিজের অসুস্থতায় চিকিৎসা নিতে গিয়ে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তার, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি আর দেশে চিকিৎসা নিতে আগ্রহী নন। চিকিৎসা সেবায় দেশে যে পরিমাণ খরচ হয়, দেশের বাইরে সে খরচও কম বলে মত তার।

বিজ্ঞাপন

কেবল নাসরিন নন, অনেকেই এখন চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে ছুটে যান। তাদের অভিযোগ, নামিদামি বেসরকারি  হাসপাতালে গেলেই আগে ২০০ টাকায় রেজিস্ট্রেশন করতে হয়, চিকিৎসকরা ফি আদায় করেন ইচ্ছামতো। এছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ যেমন বেশি, তেমনি অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে হয় রোগীদের। হাসপাতালের বিভিন্ন সেবায় অতিরিক্ত খরচ তো আছেই। এসব কারণে অসুস্থতার পেছনেই খরচ হয়ে যাচ্ছে অনেক টাকা।

কেবল সাধারণ মানুষের অভিযোগ নয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সিপিআই প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এরকম চিত্র। এসব প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, দেশে চিকিৎসার খরচ বছর বছর বাড়ছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে এই খরচ বেড়েছে ২৭ শতাংশেরও বেশি। আর চিকিৎসা সেবার পেছনে মানুষের যে ব্যয়, তার ৬৪ শতাংশই খরচ করতে হয় পকেট থেকে, সরকার থেকে বহন করা হয় এই খরচের মাত্র ২৪ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ২০১৩-১৪ সালে যে পরিমাণ স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা পেতে ১৬৪ টাকা ব্যয় করতে হতো, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে একই রকম সেবা পেতে ব্যয় করতে হয়েছে ১৮০ দশমিক ৭৭ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সেই খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৯ দশমিক ৯৪ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২০৬ দশমিক ৭০ টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খরচ ছিল ২০৯ দশমিক ২৮ টাকা। অর্থাৎ, পাঁচ বছরের ব্যবধানে একই চিকিৎসা পেতে খরচ বেড়েছে ৪৫ টাকা ২৮ পয়সা।

প্রতিবেদনে বিবিএস বলছে, শহরে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৫৫ দশমিক ৮২ টাকায় যে চিকিৎসা সেবা পাওয়া যেত, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সেই একই সেবা পেতে ব্যয় করতে হতো ১৬৯ দশমিক ৮০ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ওই সেবার পেছনে ব্যয় করতে হয় ১৮০ দশমিক ৯৩ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৮৫ দশমিক ০৫ টাকা এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৮৮ দশমিক ৯৬ টাকা।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে, গ্রামাঞ্চলে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৬৮ দশমিক ৮৭ টাকায় যে চিকিৎসা সেবা পাওয়া যেত, সেই একই সেবা পেতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্যয় করতে হয় ১৮৭ দশমিক ১৮ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ওই সেবা পেতে ব্যয় করতে হতো ২১১ দশমিক ০৪ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২১৯ দশমিক ৩৫ টাকা এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২২১ দশমিক ১৫ টাকা। সে হিসাবে শহরের তুলনায় গ্রামেই চিকিৎসার খরচ বেশি।

দেশে চিকিৎসা সেবার পেছনে খরচের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। অহেতুক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে অস্বাভাবিক খরচের কারণে অসুস্থ হলে দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়ে পড়ছে।

উদাহরণ দিতে গিয়ে ড. শামসুল বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকরা দিনে দু’বার রাউন্ড দিলে প্রতিবার দেড় হাজার টাকা করে ফি নিয়ে থাকেন। এমনকি সঙ্গে থাকা নার্সদের ফি-ও গুনতে হয়। অন্যান্য খরচ তো আছেই। সরকারিভাবে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দেশের হতদরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এসব কমিনিটি ক্লিনিকে আরও উন্নত চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করতে হবে। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সঙ্গে সেই বরাদ্দের সুষ্ঠু ও কাঙ্ক্ষিত ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে। সার্বিকভাবে আমরা মনে করি, চিকিৎসা খাতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে। এই বিশৃঙ্খলা রোধে নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন।

এদিকে, গত ২৫ মে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বিকল্প বা ছায়া বাজেট প্রস্তাব করে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। সংগঠনটির সভাপতি ড. আবুল বারকাত বাজেট উপস্থাপনের সময় বলেন, পৃথিবীর বহু দেশের তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে রোগীর নিজস্ব অর্থ ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার) অনেক বেশি। এর পরিমাণ প্রায় ৬৪ শতাংশ, সরকার বহন করে প্রায় ২৪ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল অসংক্রামক রোগের বিস্তৃতি ও চিকিৎসায় ব্যক্তিগত ব্যয়ের উচ্চ হারের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে।

ছায়া বাজেট বক্তৃতায় ড. আবুল বারকাত আরও বলেন, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দকে বিশ্ব উৎপাদনশীল বিনিয়োগের সঙ্গে তুলনা করছে। কিন্তু আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় আয়োজনেই এই খাতকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। সমাজের বিত্তশালী অংশ তো বটেই, মধ্যবিত্তরাও সুচিকিৎসার আশায় ছুটছেন দেশের বাইরে; নিদেনপক্ষে নামি-দামি কোনো বেসরকারি হাসপাতালে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বাস্থ্য সেবাদাতা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প বরাদ্দ, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অবহেলা, অসদাচরণ ও জরাজীর্ণতার প্রতীক হয়ে আছে, যা দেশের দরিদ্র জনগণের জন্য মরণাঘাতের সামিল।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি মনে করছে, স্বাস্থ্য ব্যয়ের কারণে সমাজে বৈষম্যও বাড়তে পারে। তাই স্বাস্থ্য খাতে দারিদ্র্যের রোগ নির্ণায়ক উপখাতগুলোতে সরকারি বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। এসব রোগের মধ্যে রয়েছে— যক্ষা, ম্যালেরিয়া, প্রজননতন্ত্রের রোগ, জন্মদান প্রক্রিয়ায় মা ও শিশুদের রোগ, শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ, ডায়রিয়া, হাম ও আর্সেনিকোসিস।

অর্থনীতি সমিতি বলছে, এসব রোগের হার কমাতে না পারলে আগামীতে সরকার ও পরিবার— উভয় ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তা না করতে পারলে দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হবে, মধ্যবিত্তেরও অধোগতি হবে। ফলে সমাজে বৈষম্য বাড়বে।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, কার্যকর স্যানিটেশনের অভাব, পুষ্টি সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। ফলে তারা, বিশেষ করে শিশুরা খুব সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন অভিভাবকদের সব কিছু বাদ দিয়ে শিশুর চিকিৎসা করাতে হয়। সরকারি হাসপাল বা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সব ধরনের সেবা ঠিকমতো দেওয়া হলে হয়তো মানুষের পকেট থেকে এত টাকা খরচ হতো না। এক্ষেত্রে সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবস্থাপনা  উন্নয়ন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি।

ড. জাহিদ আরও বলেন, কোনো পরিবারের একজন সদস্য যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তার চিকিৎসা করানোটাই জরুরি, সেটা ধার করেই হোক আর জমি বিক্রি করেই হোক। এই চিকিৎসার খরচ ব্যক্তি খাতের হওয়ায় চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে মানুষ দারিদ্র্য সীমার আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে মাইক্রো হেলথ ইনস্যুরেন্স চালু করা যেতে পারে। এটি করা সম্ভব।

সারাবাংলা/জেজে/টিআর

চিকিৎসা চিকিৎসা ব্যয় বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর