মুগদা হাসপাতালে ‘ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই’ অবস্থা
৩১ জুলাই ২০১৯ ২০:৫৪
ঢাকা: মঙ্গলবার (৩১ জুলাই) দুপুর ১ টা। মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অষ্টম তলায় শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে প্রথমেই চোখ পড়ে হোয়াইট বোর্ডের দিকে। নার্স স্টেশনের দেয়ালে ঝোলানো ওই বোর্ডে কালো অক্ষরে লেখা টোটাল ডেঙ্গু রোগী-৬৩ জন!
৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে বেড সংখ্যা-৬০। সেখানে শুধু ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাই ৬৩। অন্যান্য রোগে আক্রান্তের সংখ্যা আরও ১৭০। অর্থাৎ ৬০ শয্যাবিশিষ্ট একটি ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা ২৩৩। সঙ্গত কারণেই ১৭৩ জন রোগী ওয়ার্ডের ফ্লোরে, সামনের সংরক্ষিত ফাঁকা জায়গায়, এমনকি এক রুম থেকে আরেক রুমে যাওয়ার সরুপথে শয্যা পেতে রোগীর সেবা দিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
শিশু ওয়ার্ডে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের দম ফেলার সময় নেই। অতিরিক্ত রোগী নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে আছেন নার্সরা। রোগীর সেবা-যত্ন, সময়মতো ওষুধ-পত্র দেওয়া, ওয়ার্ড ব্যবস্থাপনা— সবকিছুই করতে হয় নার্সদের। তাই তাদের ব্যস্ততা একটু বেশি।
এই ব্যস্ততার মধ্যেই কথা হয় সিনিয়র স্টাফ নার্স রোজিনা ইসলামের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ’৬০ বেডের এই ওয়ার্ডে এই মুহূর্তে ডেঙ্গু রোগীই আছেন ৬৩ জন। সাধারণ রোগী আছেন আরও ১৭৩ জনের মতো। এই মাত্রাতিরিক্ত রোগী নিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।’
শুধু নার্স নয়, চিকিৎসকদের অবস্থাও প্রায় একই রকম। দায়িত্বরত চিকিৎসকদের রুমে প্রতিমুহূর্তে ঢুঁ মারছেন রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা। রুমের সামনে ভিড় লেগেই থাকছে। তিন/চারজন চিকিৎসক তাদের সাধ্যমতো সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ডেঙ্গু আক্রান্তসহ অন্য সাধারণ রোগীদের।
তবে চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের চেয়ে শতগুণ বেশি কষ্টে আছেন রোগী এবং তাদের স্বজনেরা। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী এবং স্বজনদের চোখে-মুখে আতংকের ছাপ। মুগদা হাসপাতালের এই শিশু ওয়ার্ডেই বুধবার (৩১ জুলাই) আদিব নামে ৮ বছরের একটি ছেলে মারা গেছে। ফলে অন্য রোগী ও স্বজনদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে।
শিশু ওয়ার্ডের এক ফ্লোর উপরে মেডিসিন ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডের অবস্থা আরও করুণ। ৬০ শয্যা বিশিষ্ট এই ওয়ার্ডে শুধু ডেঙ্গু রোগীই ১৭৪ জন। মোট রোগীর সংখ্যা ২৫৭ জন। ওয়ার্ডের সবগুলো রুম রোগীতে পরিপূর্ণ। ওয়ার্ডের ভেতরে ফাঁকা জায়গাগুলোতে অতিরিক্ত বেড পেতে রোগী ভর্তি করা হয়েছে। ওয়ার্ডের বাইরে লিফটির সামনে খোলা জায়গায়তেও বেড পাতা হয়েছে। পুরো ফ্লোর ভর্তি রোগী আর রোগী। সব জায়গায় ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই অবস্থা।
মেডিসিন ওয়ার্ডের বাইরে অতিরিক্ত বেডে ভর্তি জীবন বীমা করপোরেশনের কর্মকর্তা সালাহউদ্দীন আহমেদের স্ত্রী শাহিনুর বেগম। ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে পরশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি। সালাহউদ্দীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে যে পরিস্থিতি, তাতে বলা চলে কপালগুণে একটা বেড আমরা পেয়েছি। নইলে হয়তো ফ্লোরে থাকতে হতো। চিকিৎসা সেবা যা পাচ্ছি, তা নিয়ে কোনো অভিযোগ করব না। পরিস্থিতি এমনই খারাপ, সবকিছু উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিতে হবে।’
লিফটের সামনে খোলা জায়গায় শাহিনুর বেগম একটা বেড পেলেও অনেক রোগী ফ্লোরে মাদুর-কাথা বিছিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছেন ডেঙ্গু রোগীগুলো আলাদা কর্নারে রাখতে। দেয়ালে দেয়ালে নির্দেশনা লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে মশারি টাঙানোর জন্য। কিন্তু বেশিরভাগ রোগীই এই নির্দেশনা মানছেন না। মেডিসিন ওয়ার্ডে ১৭৪ ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ১০/১২ জন মশারি টাঙিয়েছেন। বাকিরা মশারি ছাড়াই রয়েছেন। এতে করে অন্য রোগী ও স্বজনদের মধ্যে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় রয়েছেন খোদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মো. খাইরুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু যেহেতু মশাবাহিত রোগ, সেহেতু সবাইকে বলা হয়েছে মশারি টাঙানোর জন্য। কিন্তু সারাদিন মশারির নিচে অনেকেই থাকতে চায় না। তারা মশারি তুলে ফেলছে। এটা রোগীর জন্য তো বটেই, অন্যদের জন্যও ক্ষতিকর।
মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যানুযায়ী এই মুহূর্তে সেখানে ২৪৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে মেডিসিন ওয়ার্ডে ১৭৪, শিশু ওয়ার্ডে ৫০ (যদিও শিশু ওয়ার্ডের বোর্ডে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা লেখা ৬৩) এবং কেবিনে ২০ জন।
অর্থাৎ ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে কেবল ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাই ২৪৪ জন। এই ২৪৪ জনের মধ্যে ২২৪ জন ভর্তি রয়েছেন শিশু ও মেডিসিন ওয়ার্ডে। যেখানে মোট বেড সংখ্যা মাত্র ১২০টি।
মুগদা হাসপাতালসহ সারাদেশে ডেঙ্গু রোগীর এই পরিসংখ্যানকে ভয়াবহ আখ্যা দিয়ে হাসপাতালটির উপ-পরিচালক ডা. মো. খাইরুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘পেশাগত জীবনে এত বড় ক্রাইসিস খুব কম দেখেছি। সাধ্যের সবটুকু ব্যয় করেও হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না।’