মশা নিধনের ওষুধ পরীক্ষা নিয়ে চলছে লুকোচুরি
৪ আগস্ট ২০১৯ ২২:৪৮
ঢাকা: মশা নিধনের ওষুধ পরীক্ষা নিয়ে লুকোচুরি চলছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে। সংস্থা দুটির শীর্ষ কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে একাধিকবার ‘মশা নিধন ওষুধের নমুনা শিগগিরই আসছে’, ‘দ্রুত কার্যকর ওষুধ আমদানি করা হচ্ছে’- এমন ঘোষণা দেওয়ার পরও ওষুধ নিয়ে আসলে কার্যকর কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে তা খোদ তারাই জানেন না।
সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মশা নিধনের ওষুধ কীভাবে আসবে, কোথায় থেকে আসবে এ বিষয়গুলো শুধুমাত্র সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারাই জানেন। ফলে তাদের সিদ্ধান্তের ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে। অন্যদিকে মশা নিধনের ওষুধ আমদানি এবং বণ্টনের দায়িত্ব থাকা দফতরের কর্মকর্তারাও মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন। ‘স্পর্শকাতর’ এ বিষয় নিয়ে দুই সিটির মেয়র ছাড়া কেউ কোনো কথা বলতে চাইছেন না।
‘মশা নিধনের নতুন ওষুধের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে’- জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বি. জেনারেল শরীফ আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না। মেয়র স্যাররা ভালো বলতে পারবেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলছে মশা নিধন ওষুধের পরীক্ষা। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। সেইসঙ্গে কবে নাগাদ কার্যকর ওষুধ দেশে আনা হবে কিংবা কবে থেকে মশা নিধনে নতুন ওষুধ ব্যবহার করা হবে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টরাও কিছু বলতে পারছেন না। এতে ডেঙ্গু রোগের ভয়াবহতার শঙ্কা বেড়েই চলেছে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন গত কয়েক বছর ধরে যে মশার ওষুধ ছিটাচ্ছে তাতে মশা মরে না বলে অভিযোগ রয়েছে। সেইসঙ্গে অভিযোগ রয়েছে, যে ওষুধ ব্যবহার করা হয় সেটিও অকার্যকর। এমতাবস্থায় হাইকোর্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর দুই সিটিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর মশা নিধনের কার্যকর নতুন ওষুধ আমদানি করতে তোড়জোর শুরু করেছে। কিন্তু কবে নাগাদ ওষুধ আনা হবে সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেননি। তবে পরীক্ষা চলছে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সে পরীক্ষার ফলাফল কোন পর্যায়ে রয়েছে সে বিষয়েও কোনো মন্তব্য নেই তাদের। অথচ বলা হচ্ছে, খুব দ্রুত ওষুধ আনা হবে।
শুক্রবার (২ আগস্ট) ডিএসসিসি নতুন মশার ওষুধ হিসেবে বায়ার করপোরেশন নামের ভারতীয় একটি কোম্পানির ‘Aque k Delthrean (Deltamethrin) 2%EW’ ওষুধটির নমুনা সংগ্রহ করে। সংগৃহীত নমুনাটি ডিএসসিসির নিজস্ব পদ্ধতিতে মান যাচাই করতে ফিল্ড-টেস্ট (পরীক্ষা) করানো হয়।
ফিল্ড টেস্টের নিয়ম অনুযায়ী, দুই বর্গস্কয়ার ফুট আয়তনের তিনটি মশারির প্রত্যেকটিতে ৫০টি করে মশা রাখা হয়। তারপর এর এক হাত দূর থেকে মশার ওষুধ দিয়ে মশারির চারপাশে ফগিং করা হয়। এরপর তাৎক্ষণিক কতগুলো মশা জ্ঞান হারিয়েছে এবং কতগুলো মশা উড়ছে সেটির ওপর নির্ভর করে ওষুধের মান যাচাই করা হয়। সেইসঙ্গে ২৪ ঘণ্টা পর কতগুলো মশা মরেছে তার ওপর নির্ভর করে ওষুধের কার্যকরিতা। এরপর যদি ওষুধের ৮০ শতাংশ কার্যকারিতা থাকে তাহলে ওষুধটি পরবর্তী পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় আইইডিসিআর এবং উদ্ভিদ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে। সেখানেও পরীক্ষা শেষে যদি ওষুধটি চূড়ান্ত করা হয় তবেই ব্যবহার করা হয় সিটি করপোরেশনে।
ঠিক একইভাবে গত শুক্রবার ভারতীয় ওই কোম্পানির ওষুধের পরীক্ষায় তিনটি নমুনার ফলাফল ছিল যথাক্রমে-২৬, ২৮ ও ১৮ শতাংশ। যার মূল ফলাফল ২৪ ঘণ্টা পর শনিবার বিকেলে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওইদিন কোনো ফলাফল দিতে রাজি হয়নি সংশ্লিষ্ট কেউ। কিন্তু পরের দিন রোববার (৪ আগস্ট) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ডিএসসিসির একাধিক দফতর ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও ২৪ ঘণ্টা পর ফলাফল কি হয়েছে তা জানা যায়নি। এমনকি যারা পরীক্ষা করেছে তারাও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান ক্রয় ও ভাণ্ডার কর্মকর্তা নুরজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভারতীয় কোম্পানির ওষুধটির ল্যাব টেস্ট চলছে। পরীক্ষা শেষে জানা যাবে। ’ ‘২৪ ঘণ্টা তো পার হয়ে গেছে, কিন্তু ফলাফল এখনও আসেনি কেন?’- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমিতো এর বাইরে কিছু বলতে পারব না।’
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুরের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
পরে মশা নিধন ওষুধের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘নতুন ওষুধ না আসা পর্যন্ত আমাদের যে ওষুধ আছে আমরা সেটাই ব্যবহার করছি। ওষুধটা কিন্তু একেবারেই কার্যকর নয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী মশা নিধনের নতুন ওষুধ আনার প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুত নতুন ওষুধ আসবে। এরই মধ্যে বেশকয়েকটি কোম্পানির ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। পরীক্ষা শেষে আইইডিসিআর আমাদেরকে যে ওষুধ ব্যবহারে নির্দেশনা দিবে সেটিই আমরা আমদানি করে ব্যবহার করব।’
এদিকে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম এ বিষয়ে প্রায় একই রকম মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘নতুন ওষুধের নমুনা পরীক্ষা চলছে। দ্রুতই নতুন ওষুধ ব্যবহার করা হবে। ’
তবে কবে নাগাদ মশা নিধনের নতুন ওষুধ ব্যবহার করা যাবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনিও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সাবরিনা ফ্লোরা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত নতুন ওষুধের মান পরীক্ষায় নমুনা আসছে। সবগুলো তো আর একসঙ্গে আসে না। যখন যেটা আসে তখন সেটা পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত মশার একসেকটিসাইড থেকে মশা নিয়ে পরীক্ষা করতে হয়। কারণ মশা তো আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওষুধের নমুনা আসার আমরা লার্ভা ধরি। লার্ভা থেকে যে মশা হ্যাশ হয়, সে মশার ওপর টেস্ট করা হয়। তার আগে মশাকে প্রিপার্ড করা হয়। তারপর টেস্ট করতে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। সুতরাং এটা টাইম কস্টিংয়ের ব্যাপার। আগে থেকে তো মশা ধরে রাখা যায় না। কারণ মশা মরে যায়। সেজন্য ওষুধ যখন আসে তখন মশার ইনসেকটিসাইডের ওপর নির্ভর করে পরীক্ষার ফলাফল। ’
‘বাংলাদেশে নতুন ওষুধ আসতে আরও কতদিন সময় লাগবে?’- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সেটাও আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না। কারণ এখনও পরীক্ষা চলছে।’
পোকা-মাকড় ও কীটপতঙ্গ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওষুধ কেনার বিষয়টা যত সহজ মনে হয় তত সহজ নয়। একটা প্রসেস মেন্টেইন করেই তা করতে হয়। কিন্তু এটার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। সুতরাং অতি দ্রুত যদি কার্যকরি ওষুধ আনতে হবে। না হলে ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।