কাশ্মীর ইস্যু: ৩৭০ ধারা, রদ ও ফলাফল
৬ আগস্ট ২০১৯ ১৫:৪৯
বাতিল করা হয়েছে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা। এর ফলে কাশ্মীরের নাগরিকদের যে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল তা উঠে গেছে, বাতিল হয়েছে স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তাটুকুও। ধারাটি বাতিলের ফলে কাশ্মীরজুড়ে শুরু হয়েছে নতুন উত্তেজনা। তার ঢেউ আছড়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। পক্ষে বিপক্ষেও দেখা দিয়েছে নানা মত।
৩৭০ ধারা:
জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতামুক্ত রেখে ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ৩৭০ ধারাটি। এই ধারাবলে রাজ্যটিকে দেওয়া হয় নিজস্ব সংবিধানের খসড়া তৈরির অনুমতি এবং সংসদের ক্ষমতাও সীমিত করা হয় ওই রাজ্যে।
এর ফলে ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিসহ কোনো কেন্দ্রীয় আইন বলবৎ রাখার জন্য রাজ্যের মত নিলেই চলে। তবে অন্যান্য বিষয়ে রাজ্য সরকারের একমত হওয়া আবশ্যক।
এছাড়া ওই আইনে তিনটি সম্ভাবনার কথাও রয়েছে। প্রথমত স্বাধীন দেশ হিসেবে থেকে যাওয়া, দ্বিতীয়ত ভারতে যোগদান অথবা পাকিস্তানে যোগদান। এ ব্যাপারে কোনো লিখিত ফর্ম না থাকলেও, কী কী শর্তে একটি রাষ্ট্রে যোগদান করা হবে, তা রাজ্যগুলি স্থির করতে পারত। অলিখিত চুক্তি ছিল, যোগদানের সময়কালীন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা না হলে, দুপক্ষই নিজেদের আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারবে। অন্যান্য বেশ কিছু রাজ্য এই বিশেষ সুবিধা ভোগ করে সংবিধানের ৩৭১, ৩৭১ এ ও ৩৭১ এল ধারার মাধ্যমে।
জওহরলাল নেহরুর উপস্থিতিতে শ্রীনগর তথা কাশ্মীরকে ভারতের অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে
ভারতভুক্তির শর্ত হিসেবে জম্মু-কাশ্মীরে সংসদ প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ- এই তিনটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে ক্ষমতাধর। কাশ্মীরের ভারতভুক্তির ৫ নং উপধারায় জম্মু-কাশ্মীরের রাজা হরি সিং স্পষ্টত উল্লেখ করে দিয়েছিলেন যে তার সম্মতি ছাড়া ভারতের স্বাধীনতা আইনে এ রাজ্যের ভারতভুক্তি কোনো সংশোধনী আইনের মাধ্যমে বদলানো যাবে না। ৭ নং উপধারায় বলা ছিল যে এই ভারতভুক্তির শর্তাবলি ভবিষ্যৎ কোনো সংবিধানের মাধ্যমে বদলাতে বাধ্য করা যাবে না।
৩৭০ ধারার পটভূমি:
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের সময় দেশভাগের সম্মুখীন হয়। এই দেশভাগের সময় জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অঙ্গ ছিল না। জম্মু-কাশ্মীর ছিল মহারাজা হরি সিং-এর স্বাধীন রাজ্য, যেখানে তারই রাজতন্ত্র চলতো। কিন্তু সেই বছরই বেশ কিছু পাকিস্তানি মদদপুষ্ট গোষ্ঠির সদস্যরা কাশ্মীর আক্রমণ করে কাশ্মীর দখলের জন্য। তখন মহারাজা হরি সিং কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে ভারতীয় সেনার সাহায্য প্রার্থনা করেন। সাহায্য চাওয়া হয় ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন’ অর্থাৎ ভারতভুক্তির শর্তে। আর তাতে জম্মু কাশ্মীর ৩৭০ নম্বর ধারা অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসনের বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার সংস্থান রাখা হয়। সেই সময় বিনা পারমিটে কাশ্মীরে কেউ প্রবেশ করতে পারত না।
মহারাজা হরি সিং
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী জম্মু-কাশ্মীর ভারতের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী রাজ্য। যে ৩৭০ ধারাবলে জম্মু-কাশ্মীরে প্রতিরক্ষা পররাষ্ট্র বা যোগাযোগের মতো কয়েকটি বিষয় ছাড়া সব ক্ষেত্রে ভারত সরকার কোনো আইন প্রয়োগ করতে গেলে সর্বপ্রথম এই জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্য সরকারের সম্মতি প্রয়োজন।
৩৭০ ধারা অনুসারে জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দারা নাগরিকত্ব সম্পত্তির মালিকানা মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে, যা দেশের অন্যান্য রাজ্যের বাসিন্দাদের থেকে আলাদা। ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তিকরণের ইতিহাস ৩৭০ ধারার ভিত্তিতে নিহিত আছে।
৩৭০ ধারায় কাশ্মীর যে সুবিধাগুলো পেয়ে থাকে
* জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দাদের দুটি নাগরিকত্ব থাকে।
* জম্মু-কাশ্মীরের রাষ্ট্রীয় পতাকা আলাদা।
* জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভার কার্যকাল ছয় বছরের অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের হয়ে থাকে।
* এমনকি জম্মু-কাশ্মীরের ভিতরে ভারতের রাষ্ট্রীয় পতাকার অপমান করা অপরাধ নয়।
* জম্মু-কাশ্মীরের কোনো মহিলা ভারতের অন্য কোন রাজ্যের কোন পুরুষের সঙ্গে বিয়ে করলে ওই মহিলার জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিত্ব বতিল হয়ে যায়।
* ঠিক একইভাবে ভারতের অন্য কোনো রাজ্যের কোনো মহিলা জম্মু-কাশ্মীরের কোনো বাসিন্দাকে বিয়ে করলে তিনি জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিকত্ব পেয়ে যান।
* ৩৭০ ধারার বলে ভারতের কোনো আইন-কানুন জম্মু-কাশ্মীরে নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য হয় না।
* ৩৭০ ধারার বলে পাকিস্তানের কোনো নাগরিক জম্মু-কাশ্মীরে থাকলে তিনিও ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে যান।
* জম্মু-কাশ্মীরে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার আইন নেই।
* ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ বা আদেশ জম্মু-কাশ্মীরের প্রযোজ্য হয় না।
* পাকিস্তানের কোনো নাগরিক জম্মু-কাশ্মীর কোনো মহিলাকে বিয়ে করলে ভারতের নাগরিকত্ব মিলে যায়।
* ৩৭০ ধারার বলে কাশ্মীরে আরটিআই, সিএজি,আরটিই প্রজোজ্য হয় না।
* কাশ্মীরে থাকা হিন্দু এবং শিখদেরও ১৬ শতাংশ সংরক্ষণ মিলে না।
* কাশ্মীরে মহিলাদের ওপর শরীয়ত আইন প্রযোজ্য রয়েছে।
* জম্মু-কাশ্মীরের ভারতের কোনো কোনো রাজ্যের বাসিন্দা জমি কিনতে না পারলেও জম্মু কাশ্মীরের বাসিন্দা ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে জমি কিনতে পারেন।
* জম্মু-কাশ্মীরের জন্য রয়েছে আলাদা সংবিধান।
যে পরিবর্তনগুলো আসছে ৩৭০ ধারা রদের ফলে
* একটি রাজ্য ছিল জম্মু ও কাশ্মীর। এখন দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরকে। এর সঙ্গে রাজ্যের মর্যাদা হারালো। রাজ্যের পরিবর্তে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করার ঘোষণা হল।
* ৩৭০ ধারায় জম্মু ও কাশ্মীরকে দেওয়া হয়েছিল বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকার। দেশের অন্যান্য রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে যেসব নিয়ম প্রযোজ্য ছিল তা জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। এখন থেকে সারাদেশের সঙ্গে একই নিয়মে বাঁধা হল জম্মু ও কাশ্মীরকে। দেশের অন্যান্য কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের নিয়ম প্রযোজ্য হবে উপত্যকাতেও।
* বিশেষ সুবিধা বলে, জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতীয় পতাকার পাশাপাশি নিজস্ব পতাকা ছিল। এখন থেকে দেশের ত্রিরঙ্গা পতাকাই জম্মু ও কাশ্মীরের একমাত্র পতাকা।
* ৩৭০ ধারার মধ্যেই ছিল ৩৫এ ধারা। ফলে বাতিল হয়েছে এই ধারাও। এই ধারা অনুযায়ী বাইরের রাজ্যের কোনো লোক জম্মু ও কাশ্মীরে স্থাবর সম্পত্তি কিনতে পারতেন না। কোনো সম্পত্তি কিনতে গেল রাজ্যে থাকতে হতো অন্তত ১০ বছর। এখন থেকে অন্যান্য রাজ্যের ভারতীয় নাগরিক জমি কিনতে পারবেন উপত্যকায়।
* কোনো নারী জম্মু ও কাশ্মীরের বাইরের কাউকে বিয়ে করলে তিনি বাবার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতেন। তার উত্তরাধিকারীরাও সম্পত্তির অধিকার পেতেন না। এখন থেকে কাশ্মীরের বাইরের কাউকে বিয়ে করলেও বাবার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন না নারীরা।
* এর আগে সংবিধানের তথ্যের অধিকারের আওতাভুক্ত ছিল না জম্মু ও কাশ্মীর।
এখন থেকে জম্মু ও কাশ্মীরে সারা দেশের মতোই প্রযোজ্য হল তথ্যের অধিকার বা আরটিআই (আরটিআই)।