Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিশ্ব মশা দিবস: গবেষণা-পরিকল্পনার অভাবে ‘জরুরি অবস্থা’


২০ আগস্ট ২০১৯ ১০:৪৩

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহ আলম। কীটতত্ত্ব নিয়ে বাংলাদেশে যে কজন গবেষক আছেন তাদের একজন অধ্যাপক শাহ আলম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪২ বছর শিক্ষকতার পর ২০১৬ সালে অবসরে যান। ২০০০ সালে যখন বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ দেখা দেয়, তখন এই রোগের বাহক এডিস মশা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন এই অধ্যাপক। প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলিও করা হয়েছিল নগরীতে। দেশে ডেঙ্গু রোগের ফের প্রাদুর্ভাবের সময় ‘বিশ্ব মশা’ দিবসকে সামনে রেখে ড. শাহ আলম সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন।

ড. শাহ আলমের মতে, মশা নিয়ে বিশেষত এডিস মশা নিয়ে গবেষণাকে রাষ্ট্র গত ৪৮ বছরে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। অথচ ৫০ বছর আগে ১৯৭০ সালেই ঢাকায় এই রোগের বাহক হিসেবে এডিস মশা শনাক্ত হয়েছিল। গবেষণার ওপর জোর দিয়ে এই মশা নিমূর্লের জন্য যদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা হতো, তাহলে বাংলাদেশে এই ‘ক্রাইসিস পিরিয়ড’ তৈরি হত না। ডেঙ্গু সংক্রমণের পর চিকিৎসার চেয়েও এডিস মশা মোকাবেলা বেশি জরুরি বলেও মত দিয়েছেন এই কীটতত্ত্ব গবেষক।

১৯৬৫ সালে ঢাকায় ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জ্বরের সংক্রমণ হয়েছিল জানিয়ে শাহ আলম বলেন, ‘সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা যেমন, এর চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জ্বর হয়েছিল। কিন্তু তখন চিকিৎসকেরা এটি যে মশাবাহিত রোগ সেটা বুঝতে পারেননি। তখন সেটা ঢাকা ফিভার নামে পরিচিতি পেয়েছিল। পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একাধিক টিম বাইরের দেশে সেটা নিয়ে গবেষণা করে। ১৯৭০ সালে এডিসি ইজিপ্টি নামে এডিস মশার একটি প্রজাতি থেকে ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে এই রোগের সংক্রমণের বিষয়টি শনাক্ত হয়।’

‘১৯৭০ সালে শনাক্ত হলেও এই মশাকে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ২০০০ সালে আমরা আবারও ব্যাপক হারে ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখি। তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এডিস ইজিপ্টি প্রজাতি নিয়ে গবেষণা করি। আমাদের আরেকজন শিক্ষক প্রফেসর নুরুল হুদা সাহেব, উনিও ব্যাপক কাজ করেছেন। চট্টগ্রামের তৎকালীন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুরোধে আমরাই প্রথম এডিস মশার লার্ভা ও পরিণত অবস্থা মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে বের করে চিত্র এঁকে উপস্থাপন করি। আমাদের গবেষণার ভিত্তিতে এডিস মশার আবাসস্থলসহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে লায়নস একটি প্রচারপত্র তৈরি করে বিলি করে।’

‘কিন্তু এরপর চট্টগ্রামে আর সেভাবে কাজ হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি টিম ঢাকা এবং উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে কাজ করেছিল। বলতে গেলে সে অর্থে ব্যাপকভাবে কোনো কাজ হয়নি। এর ফলে আমাদের ১৯ বছর পর এসে আবারও একটা ক্রাইসিস পিরিয়ড দেখতে হচ্ছে। গবেষণাটা যদি নিয়মিত হতো, এর ভিত্তিতে যদি বছরব্যাপী কর্মসূচি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের থাকতো, তাহলে এই ক্রাইসিস পিরিয়ড তো দেখতে হতো না অথবা মোকাবেলাটা সহজ হতো।’

বাংলাদেশে এখন যে ডেঙ্গু রোগের ব্যাপক সংক্রমণ, তার জন্যও দায়ী এই এডিস ইজিপ্টি প্রজাতির মশা বলে মনে করছেন এই গবেষক।

কখনকোথায় জন্মে এডিস মশা

ড. শাহ আলম জানান, ফিলিপাইন, ভারতের দিল্লী, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে এডিস মশার বংশবিস্তারের গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত সমাজের অভিজাত শ্রেণির বসবাস আছে এমন এলাকায় প্রাণঘাতী এই মশার বংশবৃদ্ধি ঘটে, প্রজনন বেশি হয়। একই চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশেও। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর- এই তিন মাস এই মশার প্রজনন ব্যাপক হারে হয়।

‘ঘরের ভেতরে ফ্রিজের নিচে বা আশপাশে জমে থাকা স্বচ্ছ পানি, শীততাপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র থেকে পড়া পানি যদি জমে থাকে, বাসার ভেতরে-বাইরে ছোট পাত্রে জমে থাকা পানি, ভবনের কার্ণিশে জমে থাকা স্বচ্ছ পানি, ফুলের টব, ডাবের খোসা, মাটি-প্লাস্টিকের পাত্র, ভাঙা মাটির বাসনে জমে থাকা পানিতে এডিস মশার উৎপত্তি হয়, যদি সেই পানি তিনদিন থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত পরিষ্কার করা না হয়। তবে সবচেয়ে বেশি এডিস মশা জন্মানোর সম্ভাবনা থাকে বাস-ট্রাক কিংবা প্রাইভেট কারের বড় পরিত্যক্ত টায়ারে। সেখানে পানি জমে থাকার পরিমাণ বেশি এবং সেটা আবদ্ধ থাকে। এতে নির্বিঘ্নে এডিস মশার বংশবিস্তার ঘটে।’

শাহ আলম বলেন, ‘ডিম পাড়ার ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে সেই ডিম ফাটে। গড়ে ১০ দিনের মধ্যে এডাল্ট মশা উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশের মতো ট্রপিক্যাল অঞ্চলে গড়ে ১০ দিনে এডিস মশা জন্ম নেয়। আর শীতপ্রধান দেশে গড়ে ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে এডিস মশা জন্ম নেয়।’

বস্তি কিংবা নিম্নবিত্তদের আবাসস্থলে এডিস মশার জন্মহার কম হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বস্তিতে কিংবা নিম্নবিত্তদের বাসাবাড়িতে যে একেবারে এডিস মশা জন্ম নেয় না, সেটা নয়। সেখানেও জন্ম নেয়, তবে কম। কারণ সেখানেও ডাবের খোসায় পানি জমে। কিন্তু গরীব মানুষ তো ডাবের খোসাকে ছোবড়া বানিয়ে বিক্রি করে। আবার বস্তির আশপাশে স্বচ্ছ পানি জমে থাকার পরিমাণ কম।’

ড্রেনে ওষুধ ছিটালে এডিস মশা মরবে না

সাম্প্রতিক সময়ে ওষুধ ছিটিয়ে এডিস মশা নির্মূলের যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে, সেটা কার্যকর কোনো পন্থা বলে মনে করেন না এই কীটতত্ত্ব গবেষক। তিনি বলেন, ‘ড্রেনে ওষুধ ছিটিয়ে লাভ কি ? সেখানে তো এডিস মশা নেই। ওষুধ ছিটাতে হবে দুই ভবনের মাঝে, কার্ণিশে, ধনী লোকদের বাসার ভেতরে। লোকজনকে বোঝাতে হবে, তারা নিজেরাও যদি সবসময় বাসায় সাধারণ স্প্রে নিয়মিত ব্যবহার করে, তাহলেও মশার প্রকোপ অনেকাংশে কমে যাবে। ওষুধ সঠিক জায়গায় ছিটাতে হবে, এর সঙ্গে কমিউনিটিকে অ্যাডজাস্ট করতে হবে, সচেতনতা তৈরি করতে হবে। না হলে কোনো ফল আসবে না।’

ডেঙ্গু মোকাবেলার জন্য সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সরকারি হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব গবেষকসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় সেল গঠন জরুরিভাবে প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক শাহ আলম।

তিনি বলেন, ‘সব কাজ মনিটরিং হবে কেন্দ্রীয় সেল থেকে। জনসচেতনতায় প্রচুর লিফলেট ছাড়তে হবে। সার্ভিলেন্স টিমকে সক্রিয় করতে হবে। খুব জোর দিতে হবে গবেষণার ওপর। যেমন পুরুষ মশা মানুষের রক্ত খায় না, স্ত্রী মশা খায়। এই ধরনের আরও যেসব বিষয় আছে, গবেষণার মাধ্যমে বের করে মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে হবে।’

‘১৯০৩ সালে কোলকাতায় প্রথম ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ হয়েছিল। সেটা নিয়ে তো ব্যাপক কাজ হয়েছে। মানুষ ম্যালেরিয়া রোগের বাহক যে মশা সেটার বিষয়ে জেনে গেছে। ম্যালেরিয়া হলে কি করতে হবে সেটাও জেনে গেছে। এর ফলে ম্যালেরিয়া এখন আর তেমন প্রাণঘাতী রোগ নয়। একইভাবে এডিস মশা সম্পর্কেও মানুষকে জানাতে হবে।’

‘কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে- আমরা অনেক সময় প্রায়োরিটিটা বুঝতে পারি না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে বরাদ্দ খুব কম। মাত্র ২৫ হাজার টাকা দিয়ে বছরব্যাপী কি গবেষণা করা যায়? অথচ এই এডিস মশা নিয়েও যে কজন গবেষণা করেন, তাদের ডেকে যদি তাদের পরামর্শটা শোনা হত, সিটি করপোরেশনগুলোতে যদি এই ধরনের সক্রিয় একটা ডিপার্টমেন্ট থাকতো, তাহলে মোকাবেলা অনেক সহজ হতো।’ বলেন ড. শাহ আলম

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহ আলম এডিস মশা কীটতত্ত্ব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর