স্পিরিটের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ, হয়ে যাচ্ছে বিদেশি ব্র্যান্ডের মদ!
২১ আগস্ট ২০১৯ ১৫:০০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্পিরিট, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, রঙ, সুগন্ধী, কোকাকোলা জাতীয় পানীয় ও ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তৈরি করা মদ চট্টগ্রামে বিক্রি হচ্ছে বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে। এসব ভেজাল মদ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি তিন জনের মৃত্যুর পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে এই চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। তাদের কাছ থেকেই এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ আরও জানিয়েছে, অনুমোদিত বিভিন্ন বার ও ক্লাব থেকে বিদেশি মদের খালি বোতল সংগ্রহ করে ভেজাল মদ ঢুকিয়ে নতুন লেভেল লাগিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় প্রতি বোতল ভেজাল মদ তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে দেড় হাজার থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত দামে। এসব ভেজাল মদ শরীরে বিষক্রিয়া তৈরি করছে।
গত ১৩ আগস্ট রাতে চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ থানার বিশ্বকলোনির মালিপাড়ায় মদপানে তিন জনের মৃত্যু হয়। এরা হলেন— বিশ্বজিৎ মল্লিক, শাওন মজুমদার জুয়েল ও মিল্টন গোমেজ। এছাড়া অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন উজ্জ্বল বণিক নামে একজন।
নগর পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) ফারুকুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানান, চার জন একসঙ্গে বসে মদপান করেছিল। তিন জন প্রায় কাছাকাছি সময়ে মারা যায়। অসুস্থ উজ্জ্বলের দেওয়া তথ্যমতে তারা যেখান থেকে মদ সংগ্রহ করেছিল, সেটার অনুসন্ধানে নামে পুলিশ। প্রথমে বিদেশি মদের একজন খুচরা বিক্রেতাকে গ্রেফতারের পর ‘বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ’ নকল হওয়ার বিষয়ে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
গ্রেফতার পাঁচ জন হলেন— মো. নাছিম উদ্দিন (২৩), মো. ইকরামুল হক (৩২), স্বপন পাল (৫১), মো. ইমরান ফয়সাল (২১) এবং জাহেদুর রহমান আরজু (৩০)। তাদের কাছ থেকে স্পিরিট, নকল লেভেল, ভেজাল মদ তৈরির বিভিন্ন উপকরণ, বোতলের কর্ক জব্দ করা হয়েছে।
আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘উজ্জ্বলের কাছ থেকে আমরা তথ্য পাই, তারা নাছিম নামে একজনের কাছ থেকে মদ কিনেছিল। নাছিমের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখি, ঘটনার পর থেকে সে এলাকায় নেই। পাঁচ দিন পর এলাকায় ফিরে সে আবারও মোটরসাইকেলে করে মদ সরবরাহ শুরু করে। আমরা তাকে বিদেশি ব্র্যান্ডের লেভেল লাগানো একটি মদের বোতলসহ আটক করি। তার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বাকি চার জনকে আটক করেছি।’
ওসি বলেন, ‘এই চক্রের আরও পাঁচ-ছয় জনের নাম পেয়েছি। তারা স্পিরিট, তিন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, কোকাকোলা, রঙ, মদের ফ্লেভার আর ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে মদ তৈরি করে। এই মদ শরীরে মারাত্মক বিষক্রিয়া তৈরি করে।’
অভিযানে অংশ নেওয়া আকবর শাহ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বিকাশ কান্তি শীল সারাবাংলাকে জানান, গ্রেফতার ইকরামুল নগরীর লালদিঘীর পাড়ের পুরাতন গির্জা এলাকায় ইকরা হোমিও ফার্মেসি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। জিজ্ঞাসাবাদে নাছিম জানিয়েছে, সে ও তার এক আত্মীয় মিলে ইকরা থেকে স্পিরিট সংগ্রহ করে। ইকরামুলকে ৪২ লিটার স্পিরিটসহ গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার স্বপন পাল নগরীর হাজারী গলির মুখে বিএস হোমিও সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। তার কাছ থেকেও স্পিরিট কেনে ভেজাল মদ প্রস্তুতকারকরা।
গ্রেফতার ইমরান ফয়সাল নগরীর নজির আহমদ চৌধুরী রোডের বন্দর প্রোডাক্টস নামে একটি প্রেসের মালিক। গ্রেফতার জাহেদুর রহমান আরজু নগরীর পাহাড়তলী এলাকার সাগরিকা প্রেসের মালিক। তারা নকল লেভেল তৈরি করে সরবরাহ করে বলে জানিয়েছেন এস আই বিকাশ চন্দ্র শীল।
অভিযানে অংশ নেওয়া আকবর শাহ থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) ইমদাদ হোসেন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে নাছিম জানিয়েছে, সে চার বছর ধরে ভেজাল মদ তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। তারা বাসায় বসে ভেজাল মদ তৈরি করে। নাছিম ও তার এক আত্মীয় মদের ক্রেতাদের কাছে অভিজাত ক্লাব-বারের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত। ক্রেতারা জানেন, নাছিমকে অর্ডার দিলে তারা বিদেশি মদ ক্লাব-বার থেকে বের করে আনতে পারেন। সেজন্য তারা প্রচুর অর্ডার পায় এবং ক্রেতাদের কাছে ভেজাল মদ সরবরাহ করে। বিদেশি ব্র্যান্ডের মদ ভেবে কিনে ক্রেতারা প্রতারিত হন।’
উপপুলিশ কমিশনার ফারুকুল ইসলাম বলেন, ‘এটি একটি সংঘবদ্ধ চক্র। তার মানে এই নয় যে, চট্টগ্রাম শহরে এরাই একমাত্র ভেজাল মদ তৈরি ও বিক্রি করে। আরও চক্র থাকতে পারে। মানুষের জীবন রক্ষায় ভেজাল মদের বিরুদ্ধে আমরা সর্বাত্মক অভিযান চালাব।’
আটক পাঁচ জনকে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওসি মোস্তাফিজুর।