আজও আঁতকে উঠি, রাতে ঘুম হয় না…
২২ আগস্ট ২০১৯ ১৬:০৯
সময়টা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেল। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ চলছে। প্রধান অতিথি ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সে সময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। সমাবেশে তাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। প্রাণে বেঁচে গেলেও আহত হন শেখ হাসিনা। সেদিনের নৃশংস হামলায় মারা যান ২৪ জন। আহত হন অসংখ্য। সেদিন সেই সমাবেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলআই’র হয়ে সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করছিলেন আশরাফুল আলম খোকন। গ্রেনেডের স্প্লিন্টার তার শরীরের এখানে ওখানে বিঁধে যায়… গুরুতর আহত হন তিনি। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় এমন ভয়াবহ হামলার শিকার হয়ে অনেকটা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিলেন এই সাংবাদিক। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রেস উইংয়ে ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঘটনার পর দেড় দশক কেটে গেছে। আজও সেই বিভীষিকাময় বিকেল তার কাছে দুঃসহ স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে। সারাবাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আশরাফুল আলম খোকন বলছিলেন, সেদিনের কথা মনে হলে আজও আঁতকে উঠি, রাতে ঘুম হয় না…
সারাবাংলা: সেদিন থমকে গিয়েছিল দেশ। একটা বিকেল হয়ে উঠেছিলো বিভীষিকাময় বিকেল। কেমন ছিল সেদিন।
আশরাফুল আলম খোকন:
সেদিন কী হয়েছিলো এটা আসলে অনেক সংবাদ করে, গল্প লিখে, কবিতা লিখে বুঝানো যাবে না। যদি নিজ চোখে কেউ না দেখে সেই ভয়াল দৃশ্য তাহলে বলে বিশ্বাস করানোর মত নয়। আপনি কত লিখবেন, কত ফুটেজ দেখাবেন, কত আর্তচিৎকার আপনি দেখাবেন, কত আহত মানুষের আহাজারি দেখাবেন, দেখিয়ে শেষ করতে পারবেন না। নিজ চোখে কেউ না দেখলে তাকে বিশ্বাসও করাতে পারবেন না।
তখন আমি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কাজ করি। আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল সেখানে। আয়রনি কী জানেন, যে কর্মসূচিতে এই গ্রেনেড হামলা হলো সেটিও মূলত ছিলো দেশের আরও কয়েকটি স্থানে বোমা-গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল ছিল, জিরো পয়েন্ট থেকে ধানমন্ডি ৩২ পর্যন্ত। আজকের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকণ্যা শেখ হাসিনা, তখন তিনি সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী। মঞ্চটা ছিল আওয়ামী লীগ অফিসের সামনেই ট্রাক মঞ্চ। ট্রাক মঞ্চে সাধারণত ডায়াস থাকে না। আমরা যারা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে কাজ করি, আমাদের একটা প্রয়োজন পড়ে, সেটা হচ্ছে আমাদের মাইক্রোফোনটা রাখতে হয়। তো ডায়াস না থাকায় মাইক্রোফোন রাখার কোনো যায়গা ছিল না। আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, আমি নিচে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে মাইক্রোফোনটা ধরে ছিলাম। তিনি বক্তৃতা শুরু করেছিলেন ৫টার কিছু আগে আগে। দীর্ঘ বক্তৃতা। অনেকক্ষণ মাইক্রোফোন ধরে রাখতে হচ্ছিলো। এটা খুব কঠিন একটা কাজ। এমন যে হাতবদলও করা যাবে না। মাইক্রোফোন নড়াচড়া করানো যাবে না কিংবা একটু রেস্ট নিয়ে যে আবার ধরবো সে সুযোগও নেই। পায়ের নিচে একটি ইটের উপর দাঁড়িয়েছিলাম। আর অনেকটা ইমব্যালান্সড অবস্থায় দাঁড়িয়েই কাজটি করছিলাম। এটিএন বাংলার সৈয়দ রিয়াজ আমার হাতটি ধরে রেখেছিলেন হাত যাতে সরে না যায়। এভাবে বক্তব্য যখন শেষ হওয়ার পথে, অনেক দিন ধরে এরকম প্রোগ্রাম কাভার করতে করতে আমাদের একটি ধারণা হয়ে যায়, ঠিক কখন বক্তব্য শেষ হতে যাচ্ছে। আমি আমাদের ক্যামেরাম্যানকে বললাম, বক্তব্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাইক্রোফোন নামাতে পারব না, তুমি ক্যাবলটা খুলে পেছন থেকে একটা লং শট নাও। দূর থাকে যাতে বুঝা যায় অনেক নেতাকর্মী। এরকম কিছু এস্টাবলিশমেন্ট শট খবরের জন্য লাগে, তাই আমি শটগুলো নিতে বললাম। ক্যামেরাম্যান ক্যাবলটা খুলে পেছনে গিয়ে শট নিচ্ছিলো। এদিকে বক্তব্যও শেষ হলো। আর বক্তব্য শেষ হতেই হঠাৎ করে মনে হল ট্রাকের যে ডালাটা থাকে, এই ডালার মধ্যে একটা ঢিল পড়ার মত শব্দ হলো, প্রথমে, উইদিন সেকেন্ডস, বিকট একটা শব্দ হলো। মনে হলো বোমা হামলা হয়েছে। গ্রেনেড হামলা হবে সেটা ভাবতে পারিনি। শেখ হাসিনার জনসভায়, বঙ্গবন্ধু কন্যার জনসভায় প্রকাশ্যে এরকম গ্রেনেড হামলা হবে এটা কখনও কল্পনায়ও ছিল না। হুমকিতো সব সময়ই ছিলো, কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে হামলা ভাবাই যেত না। আমার ভাবনায় প্রথম এলো, দুই গ্রুপের মারামারি বা এরকম কিছু হয়েছি কি না, এগুলা চিন্তা করতে করতে দেখি মানুষের চেচামেচি, চিৎকার, হুলস্থূল অবস্থা। আমি ততক্ষণে নিচে পড়ে গেছি। এদিকে পাবলিক দৌড়াদৌড়ি করছে। আমার উপর দিয়ে অনেক মানুষ মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। যেহেতু ট্রাকের পাশে ছিলাম আমি চাকাটা ধরে ট্রাকের নিচে শুয়ে পড়লাম। ওখানে শুয়ে আমি মোবাইলটা বের করলাম, চিত হয়ে শুয়ে আমাদের তখন চ্যানেল আইয়ের হেড অব নিউজ শাহ আলমগীর (বর্তমানে প্রয়াত), উনাকে কল দিলাম। তখনও গ্রেনেডের আওয়াজ আসছে। আলমগির ভাই বলছেন- কী হয়েছে কী হয়েছে? আমি বললাম আপনি- টিভিতে স্ক্রল দেন, শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলা হয়েছে। উনি একজনকে ডেকে টিকার দিতে বললেন। দিস ইজ জার্নালিজম, উনি আমার অবস্থা জিজ্ঞাস করার আগে, টিকার দিতে বললেন। এরপর আমার কাছে জানতে চাইলেন তোমার কী অবস্থা? আমি বললাম- ট্রাকের নিচে শুয়ে আছি। জানতে চাইলেন- ইনজিউরড হয়েছি কিনা। এবার আমি তাকালাম নিজের শরীরের দিকে, তখন দেখি যে আমার দুটো পায় জিনসের মোটা কাপড় ভেদ করে ছোপ ছোপ রক্ত। ছোটগুলো ক্রমশই বড় হচ্ছে চোখের সামনেই। তখন আমি উনাকে বললাম আমার অবস্থা ভালো না, বলেই আমি ফোনটা কেটে দেই।
সারাবাংলা: ট্রাকের তলায় কতক্ষণ ছিলেন?
আশরাফুল আলম খোকন: এক নিমিষে আমার মনে হলো- এখন আমার কথা বলার সময় নয়, আমাকে বাঁচতে হবে। ট্রাকের তলায় চিত হয়ে শুয়ে স্ক্রল করে করে বের হলাম। বাইরের দৃশ্যটা তখন আমার চোখে পড়ে। পুরো এলাকা রক্তে লাল, কারো পা পড়ে আছে, কারো হাত পড়ে আছে, লোকজন তখন দৌড়াদৌড়ি করছে। আমার এখন বলতে হয়ত সময় লাগছে, কিন্তু পুরো ঘটনাটা খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে গেছে। আমি বের হওয়ার পর হঠাৎ আমার সামনে একটি টিয়ারশেল এসে পড়লো। স্টেডিয়ামের দিক থেকে আসে সেটি। টিয়ারশেল জীবনে অনেক সহ্য করেছি, কিন্তু টিয়ারশেলের প্রথম ধোয়াটা বেশ বিপদজনক। ধোয়ার প্রথম কুণ্ডলীটা আমার মুখের মধ্যে এসে ঢুকছিলো। তখন আমি দুই হাত দিয়ে আমার মুখ ঢেকে রাখি। আমি জানতাম এরকম আহত অবস্থায় বমি হওয়াটা খুব ক্ষতিকর। আমার কপাল চোখ খুব জ্বলছিল। এখন দেখলাম এখান থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। প্রচুর লোকজন দৌড়াদৌড়ি করছে। আমি আবার ক্রল করে করে আওয়ামী লীগের অফিসের দিকটায় গেলাম। হঠাৎ দেখলাম আমার পায়ের কাছে কিছু একটা। ভালো করে তাকিয়ে দেখি সেটি একটি গ্রেনেড। তখন আর ধরে প্রাণ ছিলো না! কারণ গ্রেনেডের বিষয়ে জানি, পিন খোলার পর বেশিক্ষণ লাগে না ব্লাস্ট হতে। এটা দেখার পর আমি বাঁচার আশা ছেড়ে দেই। যে কোনও মুহূর্তে এটা বিস্ফোরিত হবে। এতটাই বিচলিত হয়ে গিয়েছিলাম যে চোখের সামনে নিজের মৃত্যুই দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়া, সেখানে একদম শীতলক্ষ্যা নদী ঘেঁষা আমার বাড়ি। চোখ বন্ধ করে একটা দৃশ্যই দেখতে পাচ্ছিলাম, সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা আমার লাশটা নদীর পাড়ে রাখা, আর আমার মা ও আমার দুই বোন কাঁদছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়নি। ওটি ছিলো ওই হামলায় যে কয়টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়নি তার একটা।
সারাবাংলা: এরপর কী করলেন?
আশরাফুল আলম খোকন: এরপর আমার মনে হয়েছে বাঁচতে হবে আমাকে। আমি ট্রাকের চাকা ধরে দাড়াতে চেষ্টা করলাম, দেখি দাঁড়াতে পারছি না। ততক্ষণে আমার দুটো পা অবশ হয়ে গেছে। তারপর স্ক্রল করে করে পশ্চিমের দিকে আসার চেষ্টা করলাম। সকলেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। বাইরে থেকে লোকজন আসতে পারছে না, পুলিশ টিয়ারশেল মারছে, লাঠিচার্জ করছে, এরমধ্যে আমরা যারা আছি ইনজুরড অবস্থায় তারা সবাই কিন্তু কাতরাচ্ছি, চতুর্দিকে হাত পড়ে আছে, পা পড়ে আছে, মাংস পড়ে আছে, এটার উপর দিকে ক্রল করে আমি এগুতে থাকি। কেউ কাউকে সাহায্য করার সময় নাই। ঠিক তখন এনটিভির ক্যামেরা ম্যান তারেক ওরা দোতলায় ছিলো ওরা দেখতে পায় যে আমি ক্রল করছি। তারপর ওরা এসে আমাকে তুলে সেফ সাইডে নিয়ে গেল।
https://youtu.be/X59M73HGvT4
সারাবাংলা: চিকিৎসার ব্যবস্থা কীভাবে হলো?
আশরাফুল আলম খোকন: একটা ভ্যানগাড়িতে করে আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল নিয়ে যাওয়া হলো। ভ্যানগাড়িতেও রক্ত ছিল কেউ হয়ত ফেলে দিয়ে চলে গেছে। ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়ার পর আমি একেবারে গার্ডিয়ানলেস। একদম ফেলে রেখেছে ফ্লোরের মধ্যে। কোনো ট্রিটমেন্ট নেই, সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে, আমি দেখছি পরিচিত বহু লোকজন। আওয়ামী লীগের লোকজন, ক্যাম্পাসের লোকজন, সাংবাদিকদের দেখতেছি বাট আমি যে ফ্লোরে পড়ে আছি কাউকে যে ডাকবো সে শক্তি আমার নাই। ধীরে ধীরে শরীর অবশ হয়ে গেছে, কথা বন্ধ হয়ে গেছে, একপর্যায়ে মনে হয়েছে আমি এখানেই মারা যাব। তখন হঠাৎ করে শুনতে পাই আমার নাম ধরে খোকন কই খোকন কই বলে কেউ একজন খুঁজছেন। তাকিয়ে দেখি সন্তোষ দা, আমাদের চ্যানেল আইয়ের চিফ রিপোর্টার সন্তোষ মন্ডল। উনিও আমার উপর দিয়েই একবার চলে গেলেন। আমি যে ডাক দেব, দাদা আমি এখানে, সে শক্তি আমার ছিল না। উনি ফিরে এসে আমার উপর দিয়ে আবার যখন যাচ্ছেন… আমার হাত তখন কাজ করছিলো। আমি আঙ্গুল দিয়ে উনার প্যান্টের নিচে আঙ্গুল দিয়ে আটকালাম। তখন উনি নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলে আমি পড়ে আছি। তখন তারা আমার হাসপাতাল পাল্টালেন। তখন কিন্তু কোনো হাসপাতালই আমাদের চিকিৎসা করতে চায় নি।
সারাবাংলা: সাংবাদিকতা করতে গিয়ে এরকম ঝুকিতে পড়ে যাওয়া। এটা তো পেশার কারণেই হলো। বিষয়টাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আশরাফুল আলম খোকন: ওই সময় দেশের যে অবস্থা ছিল, তাতে শুধু সাংবাদিক না- যে কারো জন্যই বিপদজনক। ওইসময়টাতে মানুষ বাসে উঠলে যদি একটা দাড়ি টুপিওয়ালা লোক দেখতো বাস থেকে নেমে যেতো। মানুষ ভয় পেত- কে কোথায় কখন কী হামলা করে বসে। এটা কিন্তু সরকার নির্দেশনা দিয়েও বলে নি, কেউ বক্তৃতা দিয়েও বলে নি, একটা পারসেপশন তৈরি হয়েছিল মানুষের মধ্যে। এমনই একটা আতঙ্কজনক পরিস্থিতি কিন্তু তখন সবার জন্যই ছিলো। মিডিয়ার ওপর প্রচুর হামলা হয়েছে তখন। ঝুঁকি তখন সব প্রফেশনেই ছিলো। সাংবাদিকতা পড়ে সাংবাদিকতায় এসেছিলাম একটা প্যাশন নিয়ে, এই পেশায় হুমকি ছিলো। তা মেনেই এসেছিলাম।
সারাবাংলা: তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী যিনি তখন একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীও। ওই দিন ওরকম কিছু হতে পারে এরকম কোনো ইন্ডিকেশন কি কারো কাছে ছিলো?
আশরাফুল আলম খোকন: আসলে যখন রাষ্ট্র কিংবা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে কোনো ইন্ডিকেশন কখনোই পাওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু কন্যা সবসময় মৃত্যু ঝুঁকিতে ছিলেন, এটার জন্য কোনো ইন্ডিকেশন লাগে না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় জড়িত থাকে ইন্ডিকেশন কোন এজেন্সি দেবে? আপনি দেখবেন ওই ঘটনার সময়ের বেশিরভাগ এজেন্সি প্রধান এখন জেলে আছেন। কারণ উনারাই জড়িত ছিলেন। বিচার তো আদালত করবে কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে বা একজন সাংবাদিক হিসেবে পরিস্থিতি দেখে কিন্তু অনেক কিছু আঁচ করা যায়। ঐদিন ঘটনার কিছু অবজারভেশনস যদি বলি, তাহলে ক্লিয়ার হয়ে যাবে। যার অন্যতম হচ্ছে, তখন শেখ হাসিনার জনসভায় নেতাকর্মী ঢুকতে গেলে মিছিল দিয়ে ঢুকতে পারত না, একজন একজন করে ঢুকতে হত পুলিশের ব্যারিকেডের কারণে। কিন্তু ঐ দিন জনসভার আশেপাশে, মানে ট্রাক মঞ্চের আশেপাশে তিন চারজন পুলিশও ছিল না। সবকিছুই ফ্রি স্টাইল ছিল একদম।
সারাবাংলা: তাতে কী ঘটনায় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা জড়িত ছিলো বলেই নিশ্চিত করে?
আশরাফুল আলম খোকন:সন্ত্রাসী ঘটনা অনেক দেশেই হয় কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হয়না যেটা আমাদের দেশে হয়েছে। কেনো বললাম আমি এটার ব্যাখ্যা দিচ্ছি, ঘটনা যখন ঘটে তখন পুলিশ যারা থাকেন বা রাষ্ট্রীয় বাহিনী তাদের কাজ হলো আহতদের উদ্ধার করা ও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। তখন পুলিশ সেটি না করে উল্টো টিয়ারশেল মেরে হামলাকারীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। বাইরে থেকে উদ্ধারকারীরা পুলিশের কারণে যেতে পারেনি। আরেকটি বিষয় ঘটনার পর দোষ এড়াতে বিএনপি-জামাত সরকার বাইরে থেকে এফবিআই নিয়ে এলো, এটা ছিলো লোক দেখানো। কারণ ওরা এসে যে আলামত দেখবে। সে আলামত ছিলো না। কোনও ঘটনা ঘটলে ঘটনাস্থল কর্ডন করে সংরক্ষিত করে রাখাই নিয়ম। কিন্তু ওইদিন সন্ধ্যা থেকে সারা রাত ধরে ঐ এলাকা ধুয়ে মুছে এমনভাবে পরিষ্কার করা হয়েছে যে পরের দিন সকালে বোঝার উপায় ছিলো না সেখানে কোনো ঘটনা ঘটেছিল। আওয়ামী লীগ ঘটনার পর মামলা করতে গিয়েছিল, পুলিশ মামলা নেয় নি। অনেকক্ষণ আওয়ামী লীগ নেতারা বসে থাকার পর এজাহার হিসেবে নিয়েছিলো মামলা নেয় নি। চতুর্থত, তখন বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সংসদে তখন এটা নিয়ে কোনো আলোচনা করতে দেওয়া হয় নি। সংসদের তখনকার কার্যবিবরণীতে কোন কিছুই মিলবে না। পঞ্চমত, একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। বিচারপতি জয়নুল আবেদনকে দিয়ে। উনি কয়দিন ঘুরে ফিরে একদিন আমার কাছেও গিয়েছিলেন কিন্তু ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলে চলে এসেছিলেন কিচ্ছু জিজ্ঞেস করেন নি। তারপর তিনি বললেন এটা ভারতের ইন্ধনে হয়েছে। ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করলেন। এরপর জজ মিয়া নামে একটা নাটক সাজানো হল। আরেকটি প্রমাণ আছে। মুফতি হান্নানের একটা স্টেটমেন্ট আছে। তিনি বলেছেন, হাওয়া ভবনে তারেক রহমান, আব্দুস সালাম পিন্টু, হারিছ চৌধুরী এবং জঙ্গিরা মিলে বৈঠক করেছে। সেটিও গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। অপর একটি ঘটনাও বলে রাখা প্রয়োজন। বছর তিনেক আগে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুতফুজ্জামান বাবর যিনি এখন ১০ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামি হয়ে জেলে আছেন তিনি কোর্টে দাঁড়িয়ে বললেন যে আমি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রাজসাক্ষী হব। পত্রিকায় সংবাদ হলো এটা। উনি কিন্তু তখন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ছিলেন। উনি যখন বললেন যে আমি সাক্ষী দেব তখন বিএনপি তড়িঘড়ি করে ওইদিন সন্ধ্যায় কোনরকম স্থায়ী কমিটির মিটিং ছাড়া, কোনো নির্বাহী কমিটির মিটিং ছাড়া তাকে আবার তড়িঘড়ি করে একটা প্রেস রিলিজ দিয়ে উনার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো। ঘটনার সময় তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। উনি সবই জানতেন। বিএনপি সেই ভয়ে উনার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছিলো।
সারাবাংলা: ঘটনার পর ১৫ বছর পার হয়ে গেছে। বিচার প্রক্রিয়া এখনো শেষ করা সম্ভব হয়নি। নিজে একজন ভিকটিম হিসেবে কী মনে হয়- বিচার প্রক্রিয়াটা আরও একটি দ্রুত হওয়া উচিত কী?
আশরাফুল আলম খোকন: বিচার শেষ করতে দেরি হয়েছে কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময়ই বলেন, তড়িঘড়ি করে বিচার করতে গিয়ে যেন একজনও নিরপরাধ ব্যক্তি ভিক্টিম হয়ে না যান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পুরো পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে। ৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে উনি চাইলে কিন্তু সে সময়েই বিচার শেষ করতে পারতেন। যেনতেন ভাবে করতে পারতেন এটা নিয়ে কেউ প্রশ্নও করত না বাংলাদেশে। কারণ নেপথ্যে অনেকেই বিরোধিতা করলেও প্রকাশ্যে কেউ এই বিচারের বিরোধিতা করবে না। উনি কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়ায়, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিচারটা সম্পন্ন করেছেন। কোনোরকমের প্রভাব খাটানো বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে একটা বেনিফিট পাওয়া যায় এরকম কিন্তু কোনো অবস্থায় তিনি যাননি , তিনি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গিয়েছেন। কারণ উনার একটা কথা হচ্ছে কেউ যেন ভিক্টিম না হয় তাড়াহুড়া করতে গিয়ে। একুশের আগস্টের মামলাটা কিন্তু আরও ক্রিটিকাল। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটা ইনডিমিনেটি দিয়ে রধ করে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু একুশে আগস্টের ঘটনাটা তারা উল্টা দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলো, তো ওখান থেকে বিষয়টি আবার জিরো পয়েন্টে নিয়ে এসে আবার সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া, এটা কিন্তু একটু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের কোর্টের তো বিচারের একটা প্রক্রিয়া রয়েছে। অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের ত সুযোগ দিতে হবে। সুতরাং বিচার স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে গেলে, প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিত করে তাদের বিচার করা হোক এটাই আমার প্রত্যাশা। তড়িঘড়ি করতে গিয়ে আবার যেন বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে আমরা পড়ে না যাই। দুই দিন পরে হোক কিন্তু বিচারটা দেখে যেন সবাই বলে নিরপেক্ষ বিচার হয়েছে।
সারাবাংলা: ওইসময় যারা আহত হয়েছিলেন তাদের ব্যাপারে এখন কী করা হচ্ছে? আপনি তো এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আছেন। কী করতে পারছেন আপনারা?
আশরাফুল আলম খোকন: এখানে আমাদের কিছু করার প্রয়োজন হয় না। যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আছেন। তিনি যখন বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন ওইসময় যেসকল নেতাকর্মী আহত হয়েছেন, ভিক্টিম হয়েছেন সবার তালিকা কিন্তু উনার কাছে আছে। আমি জানি যে অনেক মিডিয়ার কাছে নাই। অনেক মিডিয়াও তালিকা চায় আমার কাছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছু দিন আগেও সবাইকে গণভবনে ডেকেছিলেন, আমি আসার পরই আট দশ বার দেখেছি সবাইকে গণভবনের ব্যাংকুয়েট হলে ডেকে তিনি কথা বলেছেন, ওদের জন্য যা যা করণীয় কার কী সমস্যা, যারা মারা গেছে তাদের পরিবারের সদস্য, যারা আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে নিয়েছেন, সবাইকে ডেকে ডেকে উনি কথা বলেছেন। কার কী সমস্যা সে সবের খুঁটিনাটি খবর নিয়েছেন এবং ব্যক্তিগত সহকারীদের নির্দেশনা দিয়েছেন কার জন্য কী করতে হবে। আপনি যদি খবর নেন যারা ভিক্টিম আছে তাহলে আমার চেয়ে ভালো জানতে পারবেন।
সারাবাংলা: দুঃসহ সেই স্মৃতি, দমবন্ধ হয়ে থাকা ঘটনা… কীভাবে কাটিয়ে উঠলেন।
আশরাফুল আলম খোকন: সাংবাদিকতা পেশায় কোনও কিছুই পথ চলাকে থামিয়ে রাখতে পারেনা। আমার ক্ষেত্রেও হয়নি। এরপর জীবনের পথে চলেছি, পেশায় কন্টিনিউ করেছি। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। সেখানেও চ্যানেল আইয়ের সাথে কাজ করি। সেখানে আমার চিকিৎসাও হয়। শরীরে এখনো শ’ খানেক স্প্লিন্টার বহন করছি। দুই হাঁটুর প্রতিটিতে দশটির বেশি করে স্প্লিন্টার রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসক আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আমি সৈনিক কিনা? কিংবা পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করি কি না? আমার পেশা সাংবাদিকতা শুনে আর হাঁটুতে এতো স্প্লিন্টার দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। আমি যখন তাকে ঘটনাটি বলি তখন দেখলাম, উপমহাদেশের এই সহিংসতার রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা জানা।
সারাবাংলা: শরীরে এখন কোনও সমস্যা হয় কী?
আশরাফুল আলম খোকন: দুঃসহ সেই স্মৃতির কথা এখনো যখন একটা মনে ভাবি আঁতকে উঠি। একটা সময়তো সামান্য খট করে শব্দ শুনলেও আঁতকে উঠতাম। তবে এখন কোনও কোনও রাতে খুব অস্বস্তি বোধ করি দুটো পায়ে। কোনও ব্যথা নয়, একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি। সারারাত আর ঘুম হয় না।
সারাবাংলা: একটি বিকেল কতটা বিভীষিকাময় হয়ে উঠতে পারে, একটি ঘটনা দেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে তার এক উদাহরণ এই একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা। আমাদের সকলের প্রত্যাশা এমন দিন, এমন একটি বিকেল যেনো বাঙালি জাতির জীবনে আর কখনোই না আসে। আপনাকে ধন্যবাদ সারাবাংলার সঙ্গে সময় দেওয়ার জন্য।
আশরাফুল আলম খোকন: সারাবাংলাকেও ধন্যবাদ।
শ্রুতিলিখন: আতিকুল ইসলাম ইমন