ফেরার তাড়া নেই, জেঁকে বসেছে রোহিঙ্গারা
২৫ আগস্ট ২০১৯ ১৫:৩২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: মিয়ানমারে সহিংসতার শিকার হয়ে অনেকটা ‘এক কাপড়ে’ বাংলাদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন লাখ লাখ রোহিঙ্গা। উদ্বাস্তু হয়ে আসা এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে অস্থায়ীভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছেন। তবে উদ্বাস্তু এসব রোহিঙ্গাদের অনেকেই এখন ওই এলাকায় ক্যাম্পের ভেতরে হরেক রকমের দোকানসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। অনেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছেন। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ত্রাণে ভরছে পেট, ব্যবসা-চাকরির টাকায় ভরছে পকেট। এভাবে দুই বছরের মাথায় বাংলাদেশের মাটিতে অনেকটা জেঁকে বসেছেন লাখ, লাখ রোহিঙ্গা। ফলে তাদের মধ্যে স্বদেশে ফেরার কোনো তাড়া নেই।
সম্প্রতি কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতপালং এলাকার কয়েকটি ক্যাম্পে ঘুরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ক্যাম্পে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে দেওয়ায় অনেকের অভাব ঘুচেছে। অন্তত কোনো রোহিঙ্গা পরিবার এখন অনাহারে নেই। এজন্যই মিয়ানমারের ফেরার কথা উঠলেই তারা নানা ধরনের শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। এর পেছনে আবার এনজিওগুলোর ইন্ধনও রয়েছে বলে জানা গেছে।
উখিয়ার কুতপালং এলাকায় ১৭ নম্বর ক্যাম্পের ৮৫ নম্বর ব্লকের বাসিন্দা মো. ইউনূছ চাকরি করেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার ক্যাম্পকর্মী হিসেবে। মা-বাবা, ১১ ভাইবোন, তিন ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানসহ প্রায় ২৫ জন সদস্য নিয়ে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তারা পাড়ি দিয়েছিলেন কক্সবাজারে। সেখানে এসে মাসখানেক পর ইউনূছসহ তিন ভাই চাকরি নিয়েছেন বিভিন্ন এনজিওতে। মা-বাবা, ভাইদের পরিবার সবাই আলাদা-আলাদাভাবে ত্রাণ পাচ্ছেন।
ইউনূছ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বেতন ১২ হাজার টাকা। আমার ভাইয়েরাও ১২ হাজার টাকা করে বেতন পাচ্ছে। ত্রাণ যেগুলো পাই, সেগুলোতে মোটামুটি আমাদের মাস চলে যায়। আর আমরা যা আয় করি, তাতে বাজার খরচ হয়ে যায়।’
‘বাংলাদেশে কতদিন থাকবেন?’ জানতে চাইলে ইউনূছের বক্তব্য- ‘বর্মা (মিয়ানমার) যতদিন আমাদের নাগরিকত্ব না দেবে, ততদিন যাব না। আমরা এখানে ভালো আছি। কিন্তু আমরা দেশে ফিরতে চাই। আমাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে, জায়গা-জমি ফিরিয়ে দিতে হবে, না হলে আমরা সেখানে যাব না।’
বাংলাদেশ কতদিন তাদের ভার বহন করবে জানতে চাইলে ইউনূছ বলেন, ‘আমাদের তো খাওয়াচ্ছে জাতিসংঘ আর ওআইসি। বাংলাদেশের তো আমাদের জন্য কোনো খরচ নেই।’
কুতপালং ১৭ নম্বর ক্যাম্পের ৬৭ নম্বর ব্লকের বাসিন্দা ছৈয়দ হোসেন। মিয়ানমারের বুচিদং থেকে ২০১৭ সালের আগস্টে আসেন তিনি স্ত্রী ও ২ সন্তান নিয়ে। তিনি এখন পুরোদস্তুর দিনমজুর। জানালেন, ক্যাম্পের ভেতরে ঘরবাড়ি তৈরি ও মেরামতের পাশাপাশি বাইরে গিয়ে কৃষিকাজেও দিনমজুর খাটছেন তিনি। বেতন দিনে ৫০০ টাকা।
ছৈয়দ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক মাসে ১৫-২০ দিন কাজ পাই। অনেকসময় আবার পুরো মাসই কাজ করছি। বর্মায় (মিয়ানমার) রিকশা চালাতাম আর নিজের ৫০০ কানি জমিতে চাষ করতাম। সেখানে যা ইনকাম করতাম, এখানেও তা-ই করছি। আমার ছেলে কম, তাই খরচও কম।’
ফিরবেন কবে, জানতে চাইলে ছৈয়দ বলেন, ‘প্রত্যেক ক্যাম্পে ও ব্লকে আমাদের নেতা আছে। নেতারা বলেছেন- মিয়ানমার যতদিন পর্যন্ত নাগরিকত্ব না দেবে, কার্ড না দেবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের কেউ যেন ফিরতে রাজি না হই।’
এনজিও পরিচালিত একটি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে আছেন কুতপালং ১৩ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা আমির আলী। তিনি এসেছেন মা-বাবা, ৯ ভাই-বোন, স্ত্রী ও ৫ ছেলেমেয়ে নিয়ে। বাংলাদেশে আসার পর আরও এক ছেলের জন্ম হয়েছে। স্কুলে একবেলা শিক্ষকতা করে তার মাসিক আয় ১২ হাজার টাকা। তার ভাইদের কয়েকজনও বিভিন্ন এনজিওতে কর্মরত।
আমির আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্মায় আমাদের অনেক সম্পত্তি ছিল। ভিটেমাটি ছিল। এখানে অনেক ছোট জায়গায় থাকতে হয়। গরমে কষ্ট পাই। কেউ এলে বসতে দিতে পারি না। এর চেয়ে বেশি সমস্যা নেই। খাওয়া-পরা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।’
কুতপালং ১৭ নম্বর ক্যাম্প থেকে ২০ নম্বর ক্যাম্পে যাওয়ার পথে চোখে পড়বে তিনটি বাজার। সড়কের পাশে গড়ে তোলা সেই বাজারগুলোতে দেশি-ফার্মের মুরগি, গরুর মাংস, শাকসবজি, মিয়ানমারের রুই, দেশীয় বিভিন্ন ধরনের মাছ দেদারসে বিক্রি হতে দেখা গেছে। বাঁশ এবং ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া সেই বাজারের একেকটিতে কমপক্ষে ২৫-৩০টি দোকান আছে। এর বাইরে ক্যাম্পের ভেতরে মুদি দোকান, স্টেশনারি দোকান, সেলুন, মুরগির ফার্ম, ফলের দোকান, সিডির দোকান, পোশাকের দোকান, দা-বটির দোকান, চা-পান-সিগারেটের দোকান দেখা গেছে।
কুতপালং ১৭ নম্বর ক্যাম্পে পান-সিগারেটসহ একটি স্টেশনারি দোকানের মালিক মোশাররফ। তিনি সারাবাংলাকে জানান, পরিবারের ১৮ সদস্য নিয়ে এক কাপড়ে মিয়ানমার ছেড়েছিলেন। এক পয়সাও সঙ্গে করে আনতে পারেননি। বাংলাদেশে আসার পর থাকার জন্য ঘর পেয়েছেন। তিনদিন পরপর এনজিও থেকে চাল-ডাল, পেঁয়াজ, তেল-লবণ, চিনি, সুজিসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী পাচ্ছেন। রান্নার জন্য গ্যাস সিলিণ্ডার পেয়েছেন। বর্ষার ছাতা, শীতের কম্বলসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই ত্রাণ হিসেবে পাচ্ছেন।
‘এত রিলিফ খেয়ে আরও বেঁচে যায়। রিলিফ বেচে প্রথমে ১০ হাজার টাকা দিয়ে একটি দোকান খুলেছি। আমার দোকানে এখন ৮৫ হাজার টাকার মাল আছে। দিনে বিক্রি হয় ৫ হাজার টাকার ওপরে।’-বলেন মোশাররফ।
প্রায় ৫৫ বছর বয়সী আমানউল্লাহ শাকসবজি, মুরগি বিক্রি করে। ৮ ছেলেমেয়ে। এক ছেলে দিনমজুর। ৪ ছেলেমেয়েকে এনজিও’র স্কুলে পড়তে দিয়েছেন। আমানউল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের তো দুইটা হাত-দুইটা পা আছে। আমরা কাজ করতে পারি, পরিশ্রম করি। বাংলাদেশ সরকার যদি আমাদের কাজ দেয়, আমরা আরও ভালোভাবে চলতে পারব।’
‘বাংলাদেশ সরকার কেন কাজ দেবে?’- জানতে চাইলে আমানউল্লাহ বলেন, ‘তাহলে বর্মার মগদের বলুক আমাদের নাগরিকত্ব দিতে। সেটা দিলে আমরা ফেরত যাব।’
এদিকে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরা নিয়ে তালবাহানায় ক্ষুব্ধ উখিয়া-টেকনাফসহ স্থানীয় অধিবাসীরা। উখিয়া ক্যাম্পের কাছাকাছি এলাকায় বাড়ি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সুমি বড়ুয়ার। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম রোহিঙ্গারা এসেছে, আবার চলে যাবে। এখন দেখি, ফেরার নাম নেই। উল্টো তারা এমনভাবে কথা বলে, যেন দেশটা তাদের, আমরাই ভাসামান। যে কোনো সময় ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আমাদের বাড়িঘরে চলে যায়, ভাত চায়, কাজ চায়। রোহিঙ্গারা আসার পর এলাকায় চুরি-চামারি বেড়ে গেছে। কয়েকজন খুনও হয়েছে।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে তাদের নিজস্ব অর্থনীতি নিয়ে জানতে চাইলে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যে নিজস্ব হাটবাজার, দোকানপাট চালু করেছে সেটা অবশ্যই আমাদের নজরে আছে। একটা জনগোষ্ঠী যখন কোথাও অবস্থান করে তাদের বাঁচার তাগিদে অনেক কিছুই করতে হয়। রোহিঙ্গাদের ব্যবসা করার বিষয়টিও সেটাই। এখানে আইনগতভাবে এসব কর্মকাণ্ড সঠিক কি না সেটা শতভাগ যাচাই করা যাবে না। তবে আমরা তাদের এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একটা কাঠামো মধ্যে এনে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিচ্ছি। আর প্রত্যাবাসন যদি হয়ে যায়, তাহলে এই কর্মকাণ্ডও তো থাকবে না।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ ও বান্দরবানের তমব্রু সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা ঢল শুরু হয়। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার শিকার হয়ে ৭ লাখ ৪০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। নতুন-পুরনো মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বসবাস।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে পাঁচদফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ২৯ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে প্রথমবারের মতো আলোচনা হয়। ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তি সই হয়।২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৮ হাজার ৩৭৪ জনকে ফেরত নিতে রাজি হয় মিয়ানমার। ২ জুলাই জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন। ২৭ আগস্ট জাতিসংঘের প্রতিবেদনে নৃশংস গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসনের প্রথম তারিখে পাঠানো যায়নি একজনকেও। চলতি বছরের ২২ আগস্ট চীনের মধ্যস্থতায় দ্বিতীয় তারিখ নির্ধারণের পরও কোনো রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যায়নি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন অভিযোগ করেছেন, কিছু এনজিও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে না ফেরার জন্য ইন্ধন যোগাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কার্যক্রম পরিচালনা করা ইয়ং পাওয়ার সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেক এনজিও কাজ করছে। কেউ খাদ্য, কেউ জীবনমান, কেউ লিঙ্গভিত্তিক, কেউ শিক্ষা নিয়ে, কেউ ধর্ম নিয়ে কাজ করে। আবার কেউ অবকাঠামো নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় এনজিও রয়েছে। আবার একেবারে স্থানীয় পর্যায়ের এনজিও কার্যক্রম চালাচ্ছে। সুতরাং ঢালাওভাবে বললে সমাধান আসবে না। আমি মনে করি, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে এনজিওগুলোর একটা অবস্থান পরিস্কার থাকতে হবে। এবং সেটা হলো- রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে হবে। সেটা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। এখন ঢালাওভাবে অভিযোগ আসলে এনজিওগুলো যদি কাজ বন্ধ করে দেয়, তাহলে রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার সব দায় তো সরকারের ওপর এসে পড়বে। তখন সেটা আমাদের জন্যও বিরাট চ্যালেঞ্জ হবে।’
কক্সবাজার দোকানপাট নাগরিকত্ব ফেরা বাংলাদেশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মিয়ানমার রোহিঙ্গা শরণার্থী