ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত ১৫-২৫ বছর বয়সীরা
২৭ আগস্ট ২০১৯ ০০:১৩
ঢাকা: বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব পরিসংখ্যান। এ বছরের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬৪ হাজার ৭৬৫ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানায়, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সসীমার রোগীরাই বেশি ভর্তি হচ্ছেন। এ বছর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১৮ হাজার ৫৬৬ জন রোগীর বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানানো হয়।
এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে দাবি করা ১৭৩টি মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে ৮৮টি মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা করে ৫২ জনের ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে দেখা ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সসীমায় মৃত্যুর হার বেশি বলেও জানানো হয়।
আইইডিসিআর এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সাবরিনা ফ্লোরা বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় নানা রকম তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে থাকি। এছাড়াও প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা সহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিষয়েও নানা গবেষণা করে থাকি। এতে দেখা যায়, বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে পুরুষ রোগীর সংখ্যা বেশি। প্রায় ৬৪ শতাংশ পুরুষ রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। অন্য দিকে দেখা যায় ৩৬ শতাংশ মহিলা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। ১৯ হাজার ৮৬৯ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর তথ্য যাচাই করে এই সংখ্যা দেখা যায়।
তিনি আরও বলেন, পর্যালোচনা করে দেখা যায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সীরাই বেশি। ৩০ শতাংশ রোগী এই বয়সসীমার মধ্যে পাওয়া গেছে। ১৮ হাজার ৫৬৬ জন ডেঙ্গু রোগীর বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় অনুর্ধ্ব ১ বছরের বাচ্চাদের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা খুবই কম, দুই শতাংশেরও নিচে এই সংখ্যা। এক থেকে পাঁচ বছর বয়সসীমার মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সাত শতাংশ। ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সসীমার মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৭ শতাংশ। ২১ শতাংশ রোগী দেখা যায় ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সসীমার মধ্যে। ৩৫ বছর থেকে ৪৫ বছর বয়সসীমার মধ্যে দেখা যায় ১১ শতাংশ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এবার। সাত শতাংশ রোগী আক্রান্ত হয়েছেন ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সসীমার মধ্যে। এছাড়াও চার শতাংশ ৫৫ থেকে ৬৫ এবং দুই শতাংশ রোগী পাওয়া গেছে যাদের বয়স ৬৫ বছরের চাইতে বেশি।
ডা. মীরজাদী সাবরিনা ফ্লোরা বলেন, এই তথ্য উপাত্তে দেখা যায় আক্রান্তের সংখ্যা সবচাইতে বেশি সেইসব বয়সীদের মাঝে যারা স্কুল কলেজ বা কর্মক্ষেত্রের কারণে বাইরে যাচ্ছেন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষণা থেকে জানা যায়, আঠার হাজার ৪৫১ জন রোগীর মধ্যে অনুর্ধ্ব ১ বছরের ছেলে শিশু আক্রান্তের হার ৬২ শতাংশ, মেয়ে শিশুর আক্রান্তের হার ৩৮ শতাংশ। এক থেকে পাঁচ বছর বয়সসীমার মধ্যে ছেলে শিশুর হার ৫৪ শতাংশ এবং মেয়ে শিশুর হার ৪৬ শতাংশ। পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সসীমার মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ছেলে শিশুর সংখ্যা ৫৭ শতাংশ এবং মেয়ে শিশুর সংখ্যা ৪৩ শতাংশ। ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সসীমায় যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৭২ শতাংশই কিশোর ও তরুণ এবং ২৮ শতাংশ কিশোরী এবং তরুণী। ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সসীমার মধ্যে ৬৮ শতাংশ পুরুষ এবং ৩২ শতাংশ নারী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সসীমার মধ্যে ৬২ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৮ শতাংশ নারী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সসীমার মধ্যে ৫৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৩ শতাংশ নারী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। ৫৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সসীমার মধ্যে ৫৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৫ শতাংশ নারী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়াও ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধ এবং ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধা আক্রান্ত হয়েছেন যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি।
ডা. মীরজাদী সাবরিনা ফ্লোরা বলেন, এই বছর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়ার ১৭৩ টি সংবাদ আইইডিসিআরের কাছে আছে। এর মধ্যে ৮৮টি মৃত্যু পর্যালোচনা করে ৫২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে নিশ্চিত করা গেছে। এই ৫২ জনের মধ্যে নবজাতক পাওয়া গেছে এক জন। পাঁচ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের মধ্যে মারা গেছে ১২ জন যা শতাংশ হিসেবে সবচাইতে বেশি। মৃতদের মধ্যে এই সংখ্যা ২৩.১ শতাংশ। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সসীমার ৬ জন মারা গেছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যা শতাংশ হিসেবে ১১.৫ শতাংশ বলা যায়। ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সসীমার মধ্যে ৯ জন, ৩৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সসীমার মধ্যে ১০ জন এবং ৪৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সসীমার মধ্যে ২ জন মারা গেছে যা মোট মৃত্যুর যথাক্রমে ১৭.৩ শতাংশ, ১৯.২ শতাংশ ও ৩.৮ শতাংশ। এছাড়াও ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সসীমার ৪ জন এবং ৬৫ বছরের উর্ধ্বে মারা গেছেন একজন যা শতাংশ হিসেবে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৭.৭ এবং ৫.৮।
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে তাতে দেখা যায় ২৮ জন পুরুষ এবং ২৪ জন নারী আছেন। এদের মধ্যে ১২ জন ছেলে শিশু এবং ৮ জন মেয়ে শিশু আছেন যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে।
তিনি বলেন, যে ৫২ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা গেছে তাতে দেখা যায় ১৮ বছরের শিশুদের ১৬ জনের মধ্যে ১৩ জন আগেও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। একই সঙ্গে প্রাপ্তবয়ষ্ক ৩৬ জনের মধ্যে ২২ জনের পূর্বে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারেও নিশ্চিত করা গেছে। যারা মারা গেছেন তাদের মাঝে ৩৮ জন ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে এবং ছয় জন ডেঙ্গু হেমারোজিক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
ডা. মীরজাদী সাবরিনা ফ্লোরা বলেন, আইইডিসিআরের পরীক্ষাগারে ৩৪৫ জন রোগীর পিসিআর টেস্ট করে দেখা গেছে ১.৪ শতাংশ রোগী অর্থাৎ ৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ডেন-১ ক্যাটাগরিতে। ডেন-২ ক্যাটাগরিতে আক্রান্ত হয়েছেন দুই জন অর্থাৎ ০.৬ শতাংশ। ডেন-৩ ক্যাটাগরিতে আক্রান্ত হয়েছেন ২৯৮ জন যা শতাংশ হিসেবে ৮৬.৪ শতাংশ হয়। এছাড়াও ১৮ জন আক্রান্ত হয়েছে ডেন-২ ও ৩ ক্যাটাগরিতে। ডেন ১ ও ডেন ৩ ক্যাটাগরিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩.৮ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ জন। পিসিআর টেস্টে ৯ জনের রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।
আরেক গবেষণায় ৪৬৫ জন ডেঙ্গু রোগীর তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ৯৩ শতাংশ জ্বরে ভুগছিলেন। এদের মাঝে ৫৫ শতাংশ মাথা ব্যাথা, ৫২ শতাংশ শরীরে ব্যাথা, ৪৯ শতাংশ বমি বমি ভাব, ৪৩ শতাংশ মাথা ঘোরানো এবং ২০ শতাংশের পাতলা পায়খানা হওয়ার লক্ষণ ছিল। এছাড়াও ১৮ শতাংশ রোগী তলপেটে ব্যথা অনুভব করেছেন। রোগীদের অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে দেখা যায় ১৮ শতাংশ রোগীর অস্থি সন্ধিতে ব্যাথায় ভুগছিলেন, ১৩ শতাংশ চোখের মণিতে ব্যথা ছিল, ১২ শতাংশ রোগীর শরীরে চুলকানি ছিল, ৮ শতাংশ রোগী শরীরে র্যাশ ছিল, ৪ শতাংশ রোগীর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। এছাড়াও পায়খানা সঙ্গে রক্ত গেছে ৩ শতাংশ রোগীর। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে দেখা যায় ২ শতাংশ রোগী মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত আচরণ করছিলেন, দুই শতাংশ রোগী রক্তবমি করেছে এবং এক শতাংশ রোগী চামড়ায় গুটি গুটি ভাব দেখা গেছে।
উল্লেখ্য, এ বছরের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬৪ হাজার ৭৬৫ জন। শুধুমাত্র আগস্ট মাসেই ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪৬ হাজার ৩০৪ জন। অথচ ২০০০-২০১৮ এই ১৯ বছরে বাংলাদেশে সর্বমোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার ১৪৮ জন।