‘মা আর কখনও পায়ে ভর দিয়ে হাঁটবে না’
২৮ আগস্ট ২০১৯ ০১:০০
ঢাকা: ‘যাত্রী বাসে উঠা-নামায় ঝামেলা, ঠিকমত বাস পাওয়া যায় না, এ জন্য কৃষ্ণা রায় চৌধুরী অফিসের স্টাফ বাসেই সবসময় যাওয়া আসা করতেন। দুর্ঘটনার ভয়ে যাত্রীবাসে চলাচল করতেন না তিনি। তবুও আজ যাত্রীবাসের চাকায় ওনার একটা পা চলে গেল।’
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের অপারেশন থিয়োটারের (ওটি) করিডোরের সামনে কথাগুলো বলছিলেন কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর সহকর্মী স্নিগ্ধা বিশ্বাস। তিনি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব রয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর বাংলা মোটরে ট্রাস্ট পরিবহনের চাপায় বাম পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার সহকর্মী সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অর্থ বিভাগ) কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর (৫৫)। সে খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন তিনি।
হাসপাতালে এসেই সহকর্মীর মুমুর্ষ অবস্থা দেখে একমুহুর্তের জন্য থমকে যান স্নিগ্ধা বিশ্বাস। কোনোভাবেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছেন না যে, মাত্র কয়েকঘণ্টা আগেই যার সঙ্গে হাসিখুশিভাবেই কথা বলে দুপুরের খাবার খেতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ দুপুর যে আর কখনও আনন্দঘন হবে না।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, সকাল থেকেই হাসিখুশি ছিলাম আমরা। দুপুরে খেতে গিয়েছিলাম। এরপর তিনি খাওয়া সেরে দুপুর দুইটার দিকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে অফিস থেকে বের হলেন। এর ঘন্টাখানেক পর খবর পায় তার পায়ের উপর দিয়ে যাত্রী বাসের চাকা উঠে গেছে। এতে তার পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে শুনে সেখানে ছুটে যাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনি তার অবস্থা ভালো না তাই পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এরপর এখানে ছুটে আসি। এখানে এসে তার অবস্থা দেখে কোনোভাবেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছি না।’
‘চাকরির বয়স আর হয়তো তিন-চার বছর উনার। কিন্তু এ কয়বছর যদি বেঁচে থাকে তাহলে স্ট্রেচারে ভর দিয়ে আমাদের সামনে আসবে। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অনেক কষ্টের। মেনে নিতে পারছি না। যে মানুষটা যাত্রী বাসেই চড়ে না। সে মানুষটার পা-টা কেড়ে নিল সে যাত্রী বাস। বাসের চালকের কঠিন শাস্তি দাবি করছি।’
আহত কৃষ্ণা রায়ের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে কৌশিক ঢাকা বিজ্ঞান কলেজ থেকে অনার্স শেষ করেছে এবং মেয়ে ঐশ্বরিয়া চৌধুরী জগ্ননাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার উচ্চঙ্গা গ্রামে। ঢাকার মানিকনগরে ভাড়া বাসায় থাকেন তারা।
আহত কৃষ্ণা রায় চৌধরীর ছেলে কৌশিক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিকেল তিনটার দিকে একজন পুলিশ কল দিয়ে জানালেন, আমার মা দুর্ঘটনার শিকার। এরপর হাসপাতালে ছুটে আসি। পথচারীরাই মাকে হাসপাতালে দ্রুত নিয়ে গেছে এ জন্য মা এখনও বেঁচে আছেন। সবার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু মায়ের পা কেটে ফেলতে হয়েছে। মা আর কখনও পায়ে ভর দিয়ে হাঁটবে না।‘ এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ছেলে কৌশিক।
আহতের স্বামী অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক রাধেশ্যাম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুপুরে মিচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। সকালে একটা সুস্থ মানুষ অফিসে গেল। কিন্তু সুস্থ হয়ে আর বাসায় ফেরা হলো না তার।’
কোনো মামলা করেছেন কি না এমন প্রশ্নে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘কী হবে মামলা করে। বছরের পর বছর ধরে আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরতে হবে। তাও বিচার পাই কিনা সন্দেহ।’
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. খন্দকার মাসুম হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আহতের বাম পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ ছয় টুকরো হয়ে গেছে। শুধু মাংসের সঙ্গে ঝুলে আছে। কোনোভাবেই পা জোড়া লাগানোর সুযোগ ছিল না। তাই স্বামী ও সন্তানদের অনুমতিক্রমে পা কেটে ফেলা হয়েছে। তিনি এখন আপাতত শঙ্কামুক্ত বলা যায়। তিনি মাথাও আঘাত পেয়েছেন। তাই অপারেশনের পর নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে মস্তিষ্কের সিটিস্ক্যান করানোর জন্য।’
জানতে চাইলে হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বজলুর রশিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ঘটনায় বাসটি জব্দ করা হয়েছে। তবে চালক ও হেলপার কাউকে এখনও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। অভিযান চলছে।’ আহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান তিনি। তারা আহতের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় মামলা দায়েরে বিলম্ব হচ্ছে বলেও জানান তিনি।