শহীদ পরিবারের বাড়ি দখলে ৩ কোটি টাকা ঘুষ খান পুলিশের ডিসি
২৮ আগস্ট ২০১৯ ০৭:০০
ঢাকা: রাজধানীর নবাবপুরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া শামসুল হক খানের পরিবারকে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বাড়িটি দখলে নিতে লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইব্রাহিম খানকে তিন কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন এক বিএনপি নেতা। সেই টাকার একটি অংশ ওই সময়কার বংশাল থানার ওসি সাহিদুর রহমানকে দিয়েছিলেন ডিসি।
পুলিশ সদর দফতর, ডিএমপি এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
ডিএমপির পক্ষ থেকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাড়ি দখলের অভিযোগে একটি মামলায় গোয়েন্দা পুলিশ বিএনপি নেতা জাবেদসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেখানে জাবেদ অন্তত তিন কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন এবং জবানবন্দিতে তা উল্লেখ করেন।’
জানা যায়, ওই মামলার তদন্ত করেছিল চকবাজার জোনের সহকারী কমিশনার সিরাজুল ইসলাম। তদন্তে তিনিও কয়েক কোটি টাকা লেনদেনের বিষয়টি স্পষ্ট বুঝতে পারেন। সবশেষে সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ১২ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন সহকারী কমিশনার সিরাজুল ইসলাম। কিন্তু ঘুষ খেয়ে ডিসি ইব্রাহিম খান মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দেন। যার ফলে আসামিরা মামলা থেকে অব্যাহতি পান।
এদিকে ডিসি ইব্রাহিম খান বরখাস্তের পর মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে হাজির হন শহীদ পরিবারের তিন সদস্য। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তারা।
শহীদ পরিবারের সদস্য আজহারুল হক বলেন, টাকা নিয়ে ডিসি ইব্রাহিম খান বিএনপি নেতা জাবেদ উদ্দিন ও আবেদ উদ্দিনকে বাড়ি দখলে শুধু সহযোগিতাই করেননি। এমনকি ঢাকা জেলা প্রশাসক ফেরদৌস খানকেও ম্যানেজ করেছেন যাতে বাড়ির জমির মালিকানা শহীদ পরিবারের নামে না যায়।
শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে শামসুল হক খানের ছোটভাই আজহারুল হক ২০১৭ সালে একবার জমির খাজনা পরিশোধের আবেদন করেন। জমি তাদের নামে বরাদ্দ না হলে ২০১৮ সালে পুনরায় জমি বরাদ্দের আবেদন করেন। এমনকি ২০১৯ সালেও আবেদন করেছেন।
জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কয়েক দফা সাক্ষাৎ করলেও বলা হয়েছে, মামলা শেষ করে আসেন। জমিতে সমস্যা আছে, সব সমস্যা শেষ হোক। একদিকে আমাদের মামলা শেষ করতে বলেন অন্যদিকে ওই জমিতে থাকা তিন তলা ভবন ভেঙে নতুন করে ১৬ তলা ভবনের ভিত্তি দেয় এবং বেজমেন্টের কাজ করে। অথচ তাদের কিছুই বলেন না জেলা প্রশাসক।
আজহারুল হক বলেন, ‘লালবাগ বিভাগ পুলিশ ও ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতা না পেয়ে আমরা আইজিপি বরাবর লিখিত অভিযোগ করি ও সাক্ষাৎ করে বিস্তারিত বলি। এরপর আমরা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ডিজি, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও মুখ্য সচিবের দ্বারস্থ হই। তাদের কথাতেও কোনো গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না জেলা প্রশাসক ফেরদৌস খান। অবশেষে তদন্ত রিপোর্ট সাপেক্ষে ডিসি ইব্রাহিম খান সাময়িক বরখাস্ত হলেন। এতে আমরা খুশি হলেও জমির মালিকানা বুঝিয়ে না পাওয়া ও বাকিদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো লাভ নেই। তাই আমরা জমির মালিকানা বুঝিয়ে নেওয়া ও সেখানে ভবন করার অনুমতির জন্য প্রয়োজনে আবারও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের দ্বারস্থ হবো।’
নবাবপুরে দখল হওয়া সেই জমিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে জাবিন টাওয়ার নামে একটি ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে।
স্থানীয়রা জানান, ভুমিদস্যু জাবেদ ও আবেদ গং নামে দুজন এই টাওয়ার নির্মাণ করছেন। ১৬ তলা ভবনের বেজমেন্টের কাজ শেষ হয়েছে। এলাকার অনেকেই জানান, ভবনের এই জায়গাটিতে একটি তিন তলা ভবন ছিল। গত বছর যা একদিনেই সন্ত্রাসীরা দখলে নেয় এবং তিন তলা ওই ভবনটি ভেঙে ফেলেন। এরপর সেখানে ১৬ তলা ভবনের কাজ শুরু হয়। এই জমি দখল করতে বিএনপি নেতা জাবেদ ও আবেদের প্রায় ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে। এমনকি ডিসি ইব্রাহিম খানের সঙ্গে ফ্ল্যাট দেওয়ার চুক্তির কথা শুনেছেন স্থানীয় অনেকেই।
শহীদের বাড়ি দখলে পুলিশের সহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপ কমিশনার মাসুদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ অপরাধ সম্পূর্ণ ব্যক্তির দায়। পুলিশ একটি বাহিনী হিসেবে এর দায় নেবে না।’ তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী আরও যারা জড়িত তাদেরও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানান ডিসি মাসুদুর রহমান।
অন্যদিকে জমির মালিকানা শহীদ পরিবারকে বুঝিয়ে দিতে টালবাহানার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রশাসক ফেরদৌস খানকে ফোন করা হলে তিনি এ বিষয়ে সাক্ষাতে কথা বলতে বলেন।