বনসাইপ্রেমী শিক্ষক
২৮ আগস্ট ২০১৯ ০৯:৫৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে বাড়ির আঙিনায় সবজি ও ফলফুলের চাষ করতেন মো. আরিফুর রহমান। সেই শৈশব থেকেই গাছ ও লতাপাতার সঙ্গে তাঁর সখ্যতা। প্রকৃতির সঙ্গে সেই সখ্যতাই তাঁকে আস্তে আস্তে বাগান করায় অনুপ্রেরণা জোগায়। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই বাগান করা এখন তাঁর নেশা। তিনি যেখানেই থেকেছেন বাগান করেছেন, প্রকৃতির সঙ্গে থেকেছেন।
পেশায় স্কুলশিক্ষক আরিফুর রহমান ধীরে ধীরে মজেছেন ‘অসমাপ্ত শিল্পকর্ম’ বনসাইয়ের প্রেমে। নিজের বাড়ির ছাদে গড়ে তুলেছেন বনসাইয়ের বিশাল বাগান। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির পাঁচ শতাধিক বনসাইয়ের সমাহার এই বাগানে। সবুজের সমারোহ চারপাশ ঘিরে।
আরিফুর রহমান চট্টগ্রাম সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে মাস্টার্স শেষ করার পর থেকেই তিনি শিক্ষকতা পেশায় আছেন। চট্টগ্রাম নগরীর শেরশাহ হাউজিং সোসাইটিতে তাঁর নিজস্ব ছয়তলা ভবন। সেই ভবনের ছাদেই বনসাইয়ের বসতি গড়ে তুলেছেন আরিফ। স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পাড়ার লোকজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব-পরিচিতজনদের কাছে আরিফুর রহমান এখন ‘বনসাইপ্রেমী শিক্ষক’।
আরিফুরের ছয়তলা ভবনের ওপরে চিলেকোঠা, তার ওপরে ছাদ। চিলেকোঠা এবং ছাদ মিলিয়ে দ্বিতল বাগান। সোমবার (২৬ আগস্ট) সেই বাগানে গিয়ে দেখা গেছে, দেশীয় প্রজাতির হিজল, তমাল, পাকুড়, অশ্বত্থ, বাংলা বট, বাবলা, সুন্দরবনের গেওয়া, বাগানবিলাস, আমবট, চায়নাবট, তেঁতুলসহ নানা প্রজাতির বনসাই। ভারত, চীন ও ভিয়েতনাম থেকে আনা ফাইকাস, প্রেমনা, চাইনিজ এলম, বার্বাগেজ চেরি, থাইল্যাণ্ডের রাইটিয়া, মরুর দেশের জেটপ্ল্যান্টকেও বনসাই বানিয়ে চাষ করা হয়েছে এই ছাদবাগানে।
আরিফুর জানালেন, ২০১৪ সালে তাঁর বাড়ি তৈরির কাজ শেষ হয়। কাজ শেষ হওয়ার আগেই তিনি বাগান তৈরি শুরু করেন। প্রথমে ফলমূল, সবজি ও বনসাইয়ের চাষ করেছিলেন। ২০১৬ সালে সব বাদ দিয়ে শুধু বনসাই করেই বাগান সাজিয়েছেন। গত ৬ বছরে তাঁর বাগানে বেড়ে উঠেছে ৪০ প্রজাতির পাঁচ শতাধিক বনসাই গাছ।
একজন কর্মচারি নিয়ে নিজেই বাগানের পরিচর্যা করেন। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত একটানা আড়াইঘণ্টা বাগান পরিচর্যা চলে তাঁর। ছুটির দিনের পুরোটাই বাগানের পেছনে ব্যয় করেন তিনি।
‘প্রকৃতিতে গাছগুলো যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে, শুধু আকার ছোট হবে। বনসাই বানানোর মূল কাজ তো এটাই। প্রচুর ধৈর্য নিয়ে কাজ করতে হয়। আন্দাজে করলে হবে না। বিভিন্ন ফর্মুলা আছে। বড় গাছকে ছোট আকৃতিতে আনা, এটা সোজা কথা নয়। ইচ্ছেমতো ডালপালা, গাছের কাণ্ড-শেকড় কেটে দিলে হবে না। একটি বনসাই বানাতে কমপক্ষে তিন বছর সময় লাগে।’- বলেন আরিফুর।
তিনি জানান, বীজ থেকেও চারা উৎপন্ন করে বনসাই বানানো যায়। আবার গাছের ছোট চারা লাগিয়েও বনসাই বানানো যায়। টবের মধ্যে চারা রেখে তামার তার দিয়ে পাত্রের কিনারার ছিদ্রের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে, যাতে সেটির ওপরে বৃদ্ধি না হয়। এরপর নিয়মিত চারাটির কাণ্ড, শাখা-প্রশাখা নিয়মিত ছেঁটে দেওয়ার মাধ্যমে পরিচর্যা করতে হয়। বনসাই পরিচর্যার জন্য শুধু নির্দিষ্ট যন্ত্রপাতিই ব্যবহার করতে হয়। প্রতিটি বনসাইয়ের উচ্চতা হয় তিন থেকে পাঁচ ফুট।
আরিফুর রহমান বলেন, ‘বনসাই চাষকে আমরা বলছি লিভিং আর্ট। কারণ অন্যসব শিল্পকর্ম হয় জড় পদার্থ দিয়ে। শুধুমাত্র বনসাই ভিন্ন। যেহেতু প্রাণ আছে, এটা অসমাপ্ত শিল্পকর্মও বটে।’
ছাদবাগানে প্রায় ১০ লাখ টাকার দেশি-বিদেশি বনসাই গাছ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃক্ষমেলা হয়। অনেকে বিদেশ থেকে আমদানি করেন। আমি সেখান থেকে সংগ্রহ করি। তারপর বাগানে এনে পরিচর্যা করি। প্রতিটি বনসাই গাছ আমার সন্তানের মতো।’
তবে কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থেকে নয়, প্রকৃতি এবং শিল্পের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকেই গড়ে তুলেছেন বনসাই বাগান- এমনটাই জানালেন আরিফুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘আমি প্রথম বনসাই প্রর্দশনী করি ২০১৭ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে। ওই সময় আমি কোনো বনসাই বিক্রি করিনি। ২০১৮ সালেও করেছি, তখন ৪০ হাজার টাকার বনসাই বিক্রি করেছিলাম। আগামী ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর শিল্পকলায় আবারও প্রর্দশনী আছে। তবে আমি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রদর্শনী করি না। আমি বনসাইকে নিয়েছি শিল্প হিসেবে। তবে একথাও ঠিক যে, প্রত্যেক শিল্পেরই শিল্পমূল্য আছে।’
ছাদবাগানে বনসাই চাষে আরিফুর রহমানকে সহযোগিতা করেন তার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া সন্তান আদিব সারার। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাবা বনসাই ভালোবাসেন। আমিও ভালোবাসি। আমাদের বনসাই বাগান আরও বড় হবে।’
আরিফুর রহমানের বনসাই বাগান নিয়মিত দেখতে যান বন্ধুবান্ধব-পরিচিতজনেরা। মাঝে মাঝে সেই চিলেকোঠায় বনসাই চাষ নিয়ে কর্মশালাও হয়। আরিফুরের স্বপ্ন, সবুজের হাহাকারে নাভিশ্বাস হয়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরের প্রতিটি বাড়ির ছাদে একদিন বনসাইয়ের বাগান হবে।
‘আমার ছাদে লাগানো গাছ থেকে আমি প্রচুর অক্সিজেন পাচ্ছি। আমার বাড়ি সবসময় শীতল থাকে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করছে এই বাগান। এভাবে প্রত্যেক বাড়ির ছাদে যদি একটি করে বাগান থাকত, আমাদের পরিবেশটাও অনেক শীতল হতো।’- বলেন আরিফুর রহমান।